Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : খুলনাসহ উপকূলে তীব্র সংকট

শেখ হেদায়েতুল্লাহ, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

আপডেট: ২৩:৩২, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

প্রিন্ট:

নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : খুলনাসহ উপকূলে তীব্র সংকট

ছবি : সংগৃহীত

খুলনা : প্রতিরাতে ঘুমানোর পূর্বে মোবাইল ফোনে এলার্ম দিয়ে রাখেন খুলনা মহানগরীর মুসলমানপাড়ার মাহফুজ শাহরিয়ার। রাত তিনটার দিকে বাড়িতে বসানো গভীর নলকূপের মোটর চালু করতে হয় তাকে। অধিকাংশ সময়ে সহজে পানি ওঠে না।

টিউবওয়েলের উপর থেকে পানি দিয়ে তবেই মোটর চালু করতে হয়। বেলা উঠে গেলে আর পানি ওঠে না। পানি উঠিয়ে বাথরুমের বড় হাড়ি, কলসি ও বালতিতে সংরক্ষণ করে রাখতে হয় সারাদিনের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মেটাতে।

একই কথা জানালেন হাজী মেহের আলী সড়কের বাসিন্দা কাজী শান্তর। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ওয়াসার পানি পেতে ভোগান্তি। তাই বাড়িতে গভীল নলকূপ বসিয়েছি। কিন্তু নলকূপে পানি ওঠে না। ভোর ৪টার দিকে মোটর ছাড়তে হয়। কিন্তু অধিকাংশ সময় স্বাভাবিকভাবে পানি ওঠে না। নলকূপের উপর থেকে পানি দিলেই তবে পানি ওঠে। তারপরও যে পানি উঠতে সময় লাগে লাগত ২০ মিনিট। এখন সময় লাগে তিন ঘন্টা। তিন ঘন্টা মোটর চালানোর কারণে বিদ্যুত বিল বেশি ওঠে।

নগরীর জোড়াগেট সিএ্যান্ডবি কলোনীর বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, গত ১৫/২০দিন যাবত স্বাভাবিকভাবে নলকূপ থেকে মোটর দিয়ে পানি উঠছে না। বিকল্প পন্থায় পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

সূত্রমতে, মহানগরীর অধিকাংশ এলাকায় গভীর নলকূপে পানি উঠছে না। এমনকি ওয়াসার উৎপাদক নলকূপেও আশানুরূপ পানি উঠছে না। ওয়াকিবহালরা বলছেন, নগরীর পানির স্তর ক্রমশ: নামছে। বর্তমানে এই স্তর ঝুঁকিতে পড়েছে। অব্যাহতভাবে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলনের জন্যে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। এর প্রতিক্রিয়ায় নগরীর অনেক এলাকায় পানির জন্যে হাহাকার দেখা দিয়েছে।

খুলনা মহানগরীর ১৫ লাখ মানুষের প্রতিদিনের পানির চাহিদা ২৪ কোটি লিটার। কিন্তু খুলনা ওয়াসা সরবরাহ করে মাত্র ১৩ কোটি লিটার। অবশ্য, নগরীতে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং-এর সংখ্যা সাড়ে ৬৫ হাজার। এসব গ্রাহকের মাত্র ১৮ হাজার জনকে ওয়াসা পানি সরবরাহ করে। খুলনা মহানগরীর পানির চাহিদা শতভাগ উত্তোলিত হয় ভূগর্ভ থেকে। এরমধ্যে ওয়াসা ৮৩টি উৎপাদক নলকূপের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ১৩ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে। বাকি পানির চাহিদা মেটে হস্তচালিত নলকূপ এবং নলকূপে পাম্প লাগিয়ে নগরবাসী নিজেরা উত্তোলন করে। সারা বছর ধরে পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করার প্রতিক্রিয়ায় পানির স্তর কমছে, যা গরমের শুরুতেই প্রকট আকারে ধরা পড়ে।

খুলনা ওয়াসার প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত আগস্ট মাসে নগরীতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল গড়ে ১৬ থেকে ১৯ ফুটের মধ্যে। ফেব্রুয়ারি মাসে তা নেমে ২০ থেকে ২৪ ফুটে দাঁড়ায়। কিন্তু এপ্রিল মাসের শুরুতে নগরীর অধিকাংশ এলাকায় পানির স্তর ২৬ থেকে ২৮ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। এতে ওয়াসার উৎপাদক নলকুপেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম পানি উঠছে। একমাস আগে যে সময়ে দুই লাখ লিটার পানি উঠেছে, এখন সেই সময়ে এক লাখ লিটার পানিও উঠছে না। বর্ষকালে একই সময়ে একই নলকূপ হতে চার লাখ লিটারেরও বেশী পানি উঠতো।

খুলনা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ডি কামাল উদ্দিন আহমেদ-এর মতে সাধারণত: পানির স্তর ২৬ ফুটের নিচে নেমে গেলে হাতে চালানো নলকূপ থেকে পানি ওঠে না। আর পানির স্তর যদি ২৮ ফুটের নিচে নেমে যায় তাহলে বাসা-বাড়িতে মোটর দিয়ে পানি ওঠানো যায় না। ভূ-গর্ভ হতে অব্যাহতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর প্রতি বছরই কিছু না কিছু নীচে নামছে। নগরীর ৮০টি পয়েন্টে বর্তমানে পানির স্তর ২৪ থেকে ২৬ ফুটের মধ্যে রয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, পশ্চিম উপকূলে পানি সংকটের অবস্থা আমরা শহরবাসীরা গরমকালে টের পাই। খুলনা মহানগরীর বেশীরভাগ জায়গায় নলকূপের পানি না ওঠার কারণ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘ভূগর্ভের পানির ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে পুনর্ভরনের (রি-চার্জ) সমস্যা। যে পরিমাণ ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে, আনুপাতিক হারে সেই পরিমাণ পানি আবার ভূগর্ভে যাচ্ছে না।’

তিনি এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘পানি ভূগর্ভে যাওয়ার দুটি উপায়। একটি বৃষ্টির পানি আর অন্যটি ভূ-উপরিভাগের জমে থাকা (পুকুর, খাল, নদী প্রভৃতি) পানি চুইয়ে চুইয়ে যাওয়া। উপকূলীয় এলাকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে কম মাত্রায় প্রবেশ করে। সেক্ষেত্রে একমাত্র উপায় ভূ-উপরিভাগের জমে থাকা পানি। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যি খুলনা শহরে এখন পুকুর নেই বললেই চলে; আমরা সকল পুকুর বন্ধ করে ব্যবহার করে ফেলেছি।’

ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ডি কামাল উদ্দিন আহমেদ আশার কথা শুনিয়ে বলেন, পানি সংকট মোকাবেলায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পানি সরবরাহ প্রকল্প’ নামে প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মধুমতি নদী থেকে পানি এনে পরিশোধনের মাধ্যমে নগরীতে বিতরণ করা হবে। ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এভাবে আর ভূ-গর্ভ হতে পানি উত্তোলন করার প্রয়োজন হবে না। আর নগরীতে কোনো পানি সংকটও থাকবে না।

অবশ্য, দেশের পশ্চিম উপকূল জুড়েই পানি সমস্যা প্রকট। এখানে এখনও অনেক নদী। তবে নদীর পানি বেশীরভাগক্ষেত্রেই পান ও ব্যবহার অযোগ্য। কিছু জায়গায় নলকূপে পানযোগ্য পানি পাওয়া যায়, কিছু জায়গায় নলকূপেও খাবার এবং ব্যবহারযোগ্য নিরাপদ পানি পাওয়া যায় না। উপকূলভাগের পশ্চিম প্রান্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে শুরু করে পূর্বদিকের বরগুণার কলাপাড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েই পান ও ব্যবহারযোগ্য পানির আকাল বেড়েই চলেছে।

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)-এর তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় মোট ১৩টি জেলা। এরমধ্যে ছয়টি জেলা-খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুণা জেলার সুপেয় পানি পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ।

প্রকৌশলী কামালউদ্দিন আহমেদ এ সম্পর্কে বলেন, এই এলাকাটি ব-দ্বীপের নিন্মভাগে হওয়ায় ভূ-গর্ভে জলাধারের জন্যে উপযুক্ত মোটাদানার বালু বা পলিমাটির পরিবর্তে নদীবাহিত অতি সুক্ষদানার বালু ও পলি বেশী দেখা যায়। যে কারণে এসব অঞ্চলে ভূগর্ভেও পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। কোন কোন অঞ্চলে ৯০০ থেকে এক হাজার ফুট গভীরে কখনও কখনও সুপেয় পানি পাওয়া যায় না।

তিনি জানান, খুলনার পাইকগাছা, কয়রা ও দাকোপ; সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা; বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলা; পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া; বরগুনার পাথরঘাটা এবং পটুয়াখালীর গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলায় গভীর নলকূপ বসিয়েও মিষ্টি পানি পাওয়া যায় না।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer