Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ২ ১৪৩১, বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস: রোদেলা বিকেল

সৈয়দ মোকছেদুল আলম

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

আপডেট: ০২:৪৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রিন্ট:

ধারাবাহিক উপন্যাস: রোদেলা বিকেল

 মুখবন্ধ

স্বাধীনতার চেয়ে চার বছরের বড় শিশু সাগর। জন্মেই সে দেখেছে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। শুধু অদ্ভূতভাবে বিভাজিত দুই ভূখণ্ড নয়-তার চেয়ে বেশি বিভাজন দেশটির নাগরিকদের মধ্যে। বাঙালি-বিহারি, বাঙালি-পাঞ্জাবি। পারস্পারিক অবিশ্বাস-বঞ্চনা সকলের চোখে মুখে। শিশু মানসেও এর প্রভাব পড়েছে। রোদেলা বিকেল উপন্যাসের এই সূচনা অংশটি শিশু সাগরের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ ও সে সময়ের নানা টানাপোড়নের প্রতিবিম্ব। ...প্রভাষক মাসুদুল হক

এক

সাগর চৌধুরীর মন খুব খারাপ। আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার। বাবাদের জন্য বিশেষ দিন। বাবা দিবস। সাগর সাহেব ভেবে পাচ্ছেন না ছেলের সাথে কীভাবে যোগাযোগ হবে। পকেট খা-খা করছে। মোবাইল ফোনে ব্যালেন্স নেই তিন দিন ধরে। গত দুই দিন ছেলেটা বন্ধুর ফোন থেকে অনুরোধ করছে কলব্যাক করতে। বলে দিয়েছেন, ফোনে ব্যালেন্স নেই। ছেলেটা অনেক দিন স্কুলের হোস্টেল থেকে বাবার কাছে আসতে পারেনি। টানা তিন মাস বাপ-ছেলের দেখা সাক্ষাৎ নেই। মাঝেমাঝে কথা হয় মোবাইল ফোনে। কাজের চাপ আর হোস্টেলের বকেয়া টাকার সংস্থান করতে না পেরে যাবো যাবো করেও যেতে পারেন নি সাগর চৌধুরী।

এক যুগের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করছেন সাগর চৌধুরী। এর আগে বিভিন্ন পেশায় চেষ্টা করেও লেগে থাকতে পারেন নি। পারিবারিক সমস্যা কিংবা অনিয়মিত সামান্য আয় দিয়ে সবদিক কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। মন দিয়ে কাজ করতে যতটুকু আর্থিক নিরাপত্তা দরকার তা কখনো ছিল না। অর্থকষ্ট প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। পুরোপুরি সৎ উপার্জনে চলতে চেয়েছেন। অতি সাধারণ জীবন-যাপন করে মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছেন। পদে পদে ধাক্কা খেয়ে বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতার পেশা। এখানেও বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছেন। শুধু সাংবাদিকতায় মফস্বলে সৎভাবে বাঁচা সম্ভব না। এখানে সাংবাদিকতা কেবল বাহ্যিক চাকচিক্য। দুই-চারজন ছাড়া কোনো মফস্বল সাংবাদিকই বেতন বা সম্মানি চোখে দেখেন না। যারা সামান্য কিছু হাতে পান তার পরিমান কাউকে বলতে বড় লজ্জা পান। সামান্য টাকায় যাতায়াত ও মোবাইল ফোন বিলও হয় না। চলেন কী করে? সংবাদ সংগ্রহের খরচ দেয় কে?

না। প্রতিষ্ঠান থেকে আশা না করাই ভাল। বিনা পারিশ্রমিকে সাংবাদিক হওয়ার শখ আছে অনেকের। পারলে উল্টা কিছু দিয়েই সাংবাদিক হতে চান। টাকা গচ্চা দিয়ে অন্তত মফস্বল-সাংবাদিক পোষার মত কর্মস্থল নেই বললেই চলে। বিনা পয়সায় পেলে টাকা দিয়ে সাংবাদিক রাখে কে?

টানা দেড় বছর খেয়ে না খেয়ে রাতদিন খেটে চাকরি পাকা করেছেন সাগর চৌধুরী। তারপর বেতন ঠিক হয়েছে ৮শ’ টাকা। সাগর চৌধুরীর ভাগ্য ভাল। তিনি খুব সহজেই একটা নামি পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হয়েছেন। শীর্ষ দৈনিকগুলোর একটি। আগে সার্কুলেশন লাখের আশেপাশে ছিল। এখন ৩০-৩৫ হাজার সার্কুলেশন। এই ক্ষয়িষ্ণু যৌবনা পত্রিকার দুর্দিনে সাগর চৌধুরীর যোগদান। বেতন টিক হলেও মাস গেলে হাতে পাওয়া যায় না। এভাবে আরও এক বছর। ঘরে বউ এর মুখ ঝামটা। বাচ্চা ছেলেটার দিকে তাকানো যায় না। সাগর চৌধুরীর এক বেয়াই ছেলেটাকে দেখে বললেন, আপনার বাচ্চাটাতো অপুষ্টিতে ভুগছে। ওর একটু যত্ন করেন। শাক-সবজি, ফল-মূল খাওয়ান।

স্কুল জীবনে সাগর চৌধুরী ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। অভিনয়ে খুব ঝোঁক। নানা অনুষ্ঠান, পরিবার ও বন্ধুমহলে কৌতুক করে সবার কাছে এক নামে চেনা। যেমন খুশি তেমন সাজ তে একটা না একটা পুরষ্কার জুটতই। কেবল জিয়াউর রহমানের আমলে খাল কাটার চরিত্র করে কোনো পুরষ্কার জোটেনি।

বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর দেশে একটা থমথমে ভাব। তখন সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। এতো বড় একটা ঘটনায় কেউ তেমন উচ্চ-বাচ্য করছে না কেন এ প্রশ্ন মনে আসেনি। স্বাধীনতার পর সাগর চৌধুরী পরিবারের সবাইকে খুব কষ্ট করতে দেখেছেন। তিন বেলা ভাত খেয়ে অভ্যস্থ পরিবারের সদস্যদের দু’বেলা রুটি খেতে হয়েছে। সেই দিনগুলো সে ভুলতে পারে না। বাবা ছিলেন রেলের ছোট বাবু। স্টাফরা ‘ছোটবাবু’ বলে ডাকতেন। ‘বড়বাবু’ ছিলেন মুচ্ছুর বাবা। পাশের কোয়ার্টারে থাকতো এই বিহারি পরিবার। মুচ্ছুরা কথা বলতো উর্দু ভাষায়। মুচ্ছুর বাবা বাঙালিদের সাথে জগাখিচুরি বাংলায় কথা বলতেন। সাগরকে আদর করে ডাকতেন ‘ঢেঁড়স’।

কেন ঢেঁড়স বলে ডাকতেন তা সাগর বা অন্য কেউ জানে না। সাগর ফর্সা স্বাস্থ্যবান আদুরে বালক। সবাই আদর করে। দেখা হলেই মুচ্ছুর বাবা গাল টিপে জিজ্ঞেস করতেন, ঢেঁড়স তুম খানা খায়া? ঢেঁড়স মাথা নেড়ে ‘না’ বলতো। ঢেঁড়সের ধারণা খানা মানে পোলাও-কোরমা। তার বাবা ঈদে পোলাও-কোরমা খেয়ে মায়ের প্রশংসা করতেন। বলতেন, খানা পাকানো খুব ভাল হয়েছে। মুচ্ছু প্রতিদিন বলতো খানা খেয়ে এসে খেলবে। ওঁরা কতই না বড় লোক! সব সময় খানা খায়। আচ্ছা, ঢেঁড়স যদি ওদের পরিবারের কেউ হতো রোজ খানা খেতো। প্রতি বেলা।

১৯৭১ সালে সাগরের বয়স ৪ বছর। শেখ মুজিবুর রহমানের নামটা শুনতে শুনতে মনে গেঁথে গেছে। দশাসই চেহারাটাও। সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি কালো মোটা কোট। দেখলেই ভক্তি হয়। গভীর শ্রদ্ধা জাগে। খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে। মনে হয় কত আপন কত চেনা। এই বুঝি ঢেঁড়স তাঁর হাত ধরে নায়কের মত দেশ জয় করে ফেলবে।

পাশের বাড়ির অজিতদা ছোট চাচাকে ফিসফিস করে অনেক কথা বলেন। এইবার গণ্ডগোল বাঁধবে। বিহারিরা খুব বেড়েছে। তাদের দাপটে কোথাও টেকা দায়। পাকিস্তানি মিলিটারিদের দাপটে বাঙালি মিলিটারিরা মুখ খুলে না। দু’জন পাকিস্তানি মিলিটারি বড় জ্বালায় সবাইকে। একজন আলতাফ সুবেদার আরেকজন করম আলী। চওড়ায় বেশি বলে আলতাফকে খাটো লাগে। মাথায় পাতলা চুলের ফাঁকে তেল চিকচিকে টাক দেখা যায়। গোলগাল ঘুষখোর পুলিশের চেহারা। কোমড়ের বেল্ট ফেটে উপচে পড়া ঢাউস পেট। বড় বড় টকটকে লাল চোখ। ঘন জোড়া ভ্রু। ঠোঁট ঢেকে ঝুলে পড়া মোটা গোঁফের দুই দিক উপরের দিকে অর্ধ চাঁদের মত বাঁকানো। বারবার গোঁফের আগা মোচড়ায় আর চোখ পাকিয়ে কথা বলে। গায়ের রং মিশকালো। হাতে-বুকে বড় বড় লোম। খাকি পোশাক পড়া ভাল্লুকের মত দেখতে। কোমরে ওয়েস্টার্ন সিনেমার কায়দায় পিস্তল ঝোলানো। হাতে সব সময় মোটা একটা লাঠি নাড়াচাড়া করেন।

সাগরের বাবা খসরু চৌধুরী প্রায়ই আলতাফ সুবেদারের গল্প করেন বাসায়। স্টেশনে এসে খুব উৎপাত করে। স্যুইপারকে পিটিয়ে আধ মরা করেছে। স্যুইপারের ঘরে সব সময় নেশা করে আলতাফ। স্যুইপারের বউকে নিয়ে সেদিন মাতাল আলতাফ টানা হেঁচড়া করছিল। স্যুইপার তাতে বাধা দেয়। সামান্য স্যুইপার তাকে বাধা দেয় এত বড় সাহস! পিটিয়ে বেচারা স্যুইপারকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় সে।

এ ঘটনা শুনার পর আলতাফ সুবেদার সাগরের কাছে এক ভীতিকর চরিত্র। ছোট বলে বাবা সাগরের সামনেই মাকে সব বলতেন। শুনে শুনে সাগর বুঝে ফেলে আলতাফ লোকটা মোটেও ভাল না। (চলবে)

 

[email protected]  

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer