ছবি : মো: ফখরুল ইসলাম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
চার
২৫ মার্চ ১৯৭১। ভোর রাতে খসরু চৌধুরী নাইট ডিউটি থেকে বাসায় ফিরলেন। থমথমে গম্ভীর মুখ। স্ত্রী বকুল স্বামীর অন্ধকার মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন-কী খবর? কী হয়েছে?
খসরু চৌধুরী বললেন, খবর খু-উ-ব খারাপ। ঢাকায় নাকি ম্যাসাকার করে ফেলেছে পাক সেনারা। মধ্য রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে বাঙালিদের শিয়াল কুকুরের মত গুলি করে মেরেছে। সর্বত্র লাশের স্তুপ। দেশে খুব বড় একটা গ-গোল বেঁধে যাবে। মুচ্ছুর বাবা তোমাদের সবাইকে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বললেন।
জয়দেবপুর থেকে কালিয়াকৈর ১৭ মাইল। খসরু চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি আরও তিন মাইল ভেতরে। পূর্ব-দক্ষিণ দুই দিক থেকে গ্রামটি ঘিরে আছে তুরাগ নদ। পশ্চিম দিকেও দিগন্ত বিস্তৃত বিলের অথৈ জলরাশি। কেবল উত্তর দিক থেকে মেঠোপথ ধরে গ্রামে প্রবেশ করা যায় পায়ে হেঁটে। কোথা থেকে কাকডাকা ভোরে খসরু চৌধুরী দু’টি ব্রিটিশ আমলের বেবি টেক্সি জুটিয়ে আনলেন। পরার জরুরি কিছু কাপড় আর সবার শখের থ্রি ব্যান্ড ফিলিপস্ রেডিও ছাড়া সঙ্গে অন্য কিছু নেই। পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে মা বকুল চললেন শ্বশুর বাড়িতে। স্বামীকে অনিশ্চয়তার মধ্যে একা ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু সন্তানদের নিরাপত্তার প্রশ্নে আপস করতে হচ্ছে।
পথে পথে পাক আর্মির জলপাই রঙের কনভয় এর ছুটাছুটি আর ঘাটে ঘাটে চেকপোস্ট। প্রতিটি চেকপোস্টে পাক আর্মিরা বাঙালি যাত্রীদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চেকিং করছে। নানা প্রশ্ন করছে। উত্তর সন্তোষজনক হলে ছেড়ে দিচ্ছে। না হলে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। ঢেঁড়সের সুন্দরী বোনটি কালো বোরখা পরে ভাল করে নিজেকে লুকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। হাতে-পায়ে মোজা। দেখার জন্য শুধু চোখ বরাবর দুটি ছিদ্র ছাড়া কোনো ফাঁক নেই।
জয়দেবপুর চৌরাস্তায় চেকিংয়ের সময় আলতাফ সুবেদার এগিয়ে এসে মার সাথে ঢেঁড়সকে দেখতে পেয়ে চিনতে পারলেন। কোথায় যাচ্ছে জানতে পেরে আলতাফ বললেন-সমস্যা নাই। করম আলী চন্দ্রার চেক পোস্টের দিকে যাবে। তাকে বলে দিচ্ছি। আপনাদের যেতে অসুবিধা হবে না।
একটু পর করম আলীকে নিয়ে আলতাফ ঢেঁড়সদের বেবি টেক্সির কাছে আসে। ভোমা সাইজের একটা মোটর সাইকেলে চড়ে করম আলী এগিয়ে যায় কালিয়াকৈরের পথে। হাত ইশারায় তাকে ফলো করতে বললেন ঢেঁড়সদের বেবিটেক্সি দুটোকে।
বেশ গার্ড অব অনার দিয়ে ঢেঁড়সদের পরিবার নির্বিঘ্নেই পৌঁছে যায় গ্রামের বাড়িতে। মা বকুল শ্বশুরকে কদমবুচি করেন। শ্বশুর খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, হঠাৎ তোমরা? রাস্তায় কোনো বিপদ হয় নাই তো? বকুল উত্তরে বলেন-আল্লার মর্জিতে ভালভাবেই আসছি আব্বা।
বহুমাত্রিক.কম