Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

দেশের ভ্রমণ তীর্থ : টুঙ্গিপাড়া থেকে মুজিবনগর

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ০২:৩৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

দেশের ভ্রমণ তীর্থ : টুঙ্গিপাড়া থেকে মুজিবনগর

-টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি। ছবি : সংগৃহীত

এক.
দেশ বিদেশে বিভিন্ন রকমের তীর্থস্থান থাকে। তারমধ্যে দর্শীয় তীর্থস্থান, ঐতিহাাসিক তীর্থস্থান, ভৌগোলিক তীর্থস্থান, পৌরাণিক তীর্থস্থান ইত্যাদি ইত্যদি। বিশ্বে যত ধরনের তীর্থস্থান রয়েছে তারমধ্যে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ইত্যাদি জাতিগত ঐতিহাসিক তীর্থস্থান অন্যতম। তবে সেগুলো ইতিহাসের সাথে সবচেয়ে বেশি অংশজুড়ে যিনি জড়িয়ে রয়েছেন তিনি হলেন বাঙালি জাতির স্রষ্টা, সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির ইতিহাসের হাজার বছরের মহানায়ক, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে ঘিরে এদেশে বেশ কয়েকটি ইতিহাস কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান এক সময়ের পিছিয়ে থাকা জনপদ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া এবং আরেকটি হলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে গঠিত প্রবাসী অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের মেহেরপুরের মুজিবনগর। শুধু আমি নই আজ কোটি কোটি বাঙালি এসব স্থানকে বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান মনে করে।

কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যায় জুন মাসে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ থাকে। ২০১৪ সালের জুন মাসের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে তাই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গদের কয়েকজনের একটি টিম সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের এ দুটি তীর্থস্থান ভ্রমণ করবো। সেইসাথে একই রাস্তার সাথে মিলিয়ে কুষ্টিায়াতে ফকির লালনের মাজার এবং শিলাইদহতে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি পরিদর্শন করে আসবো।

ঠিক সেরকম একটি উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহীত উল আলম, ট্রেজারার প্রফেসর ড. মো. আবুল বাসার, রেজিস্ট্রার হিসেবে আমি ড. মো. হুমায়ুন কবীর, হিসাব বিভাগীয় প্রধান মো. নজরুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির আরো কয়েকজন যথা- রেজুয়ান আহমেদ শুভ্র, মাসুম হাওলাদার ও শিল্পী ফখরউদ্দিন সৈকত, ভিসির পিএস মো. আব্দুল হালিম এবং দুজন ড্রাইভার নজরুল ইসলাম ও এরশাদ তালুকদারসহ মোট ৮-৯ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়লাম সে তীর্থযাত্রায়। শর্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ও ট্রেজারারের দুটি গাড়িতে ভ্রমণ করবো ঠিকই কিন্তু তেলখরচ এবং উক্ত জার্নির জন্য রাস্তায় সকল খরচ হিসাব করে প্রত্যেকে নিজ নিজ ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ব্যয়ভার বহন করবে। আমরা সবাই ভাগাভাগি করে উক্ত ব্যয় পরিশোধ করবো। যেই কথা সেই কাজ। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ভোরবেলায় ঢাকা থেকে মাওয়া ফেরিঘাট হয়ে প্রথমে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তারপর সেখান থেকে মুজিবনগর যাওয়া হবে। আর ভোরবেলায় ঢাকা থেকে বেরোতে হলে আমরা যারা ময়মনসিংহ থেকে যাব তারা আগের রাতে ঢাকায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ অফিসে রাত্রিযাপন করলাম।

পরদিন ভোরবেলা রওয়ানা করলাম মাওয়া ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে। কারণ সকালের ঢাকায় যানজট শুরু হয়ে যাওয়ার আগেই আমরা ঢাকা শহর পেরিয়ে যাবো। পরিকল্পনামাফিকই কাজ হলো, দেখা গেল ঠিক এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময়েই আমরা মাওয়া ফেরিঘাটে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু ভোরে না হলে পুরান ঢাকার যানজট থেলে এতসহজে পৌঁছা যেতো না। ফেরিতে উঠে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম বিধায় সেখানে ভিআইপি কেবিনে রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পেলাম। কেবিনে নিজেদের সাথে নেওয়া কিছু নাস্তা দিয়ে হালকা রিফ্রেশমেন্ট সেরে নিলাম। তারপর সেখানে কফি খেয়ে নিলাম। কেবিনে বসে আরাম করলে ফেরির বাহিরের নদীর পানির কলকলানি দেখা যাবে না- এ চিন্তা থেকে সবাই ফেরির ছাঁদে উঠে যার যার মতো করে ছবি উঠাতে লাগলাম। সকালের নদীর আবহাওয়া কেমন লাগে বহুদিন পর তার অনুভুতি নিলাম। সবমিলে দেড় থেকে দুইঘণ্টা সময় ফেরিতে কাটালাম। কিন্তু অন্যসময় একা একা এসব জার্নি খুবই বোরিং মনে হলেও আজ তেমনটি মনে হয়নি। বরং উপভোগ্য মনে হয়েছে। ফেরির ছাঁদের উপর দিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে। চারিপাশে খোলা আকাশ, মাঠ আর মাঠ নদীর চর তা দেখলে মনটা জুড়িয়ে যায়।

জুন মাস হওয়ায় সেবছর বন্যার পানি উঠেনি সেজন্য নদীর দুকূল তখনো ভরে উঠেনি। মাঝেমধ্যে ওপাশ থেকে আসা দুয়েকটি ফেরি, অনেক লঞ্চ, ছোটবড় নৌকা ফেরিকে ক্রস করছে। তবে সবচেয়ে বেশি বিপদজনক মনে হলো স্পিডবোটগুলোকে। তারা ফেরির পাশে দিয়ে পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে সাই সাই করে চলে যাচ্ছে। আমাদের টিমে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে বাড়ি এমন ট্রেজারার মহোদয় এবং মাসুম হাওলাদার ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে এসব এলাকায় কেমনে নৌকা, লঞ্চ, স্পিডবোট, স্টিমার ইত্যাদি জলযান বিভিন্ন সময়ে কখনো ঝড়ের কবলে আবার কখনো ¯্রােতের তোড়ে দুর্ঘচনা ঘটে তার লোমহর্ষক বর্ণনা শুনছিলাম। এভাবে দেখতে দেখতে খুব সহজেই সময় পার হয়ে গেলো এবং আমরা কাওড়াকান্দি ঘাটে গিয়ে নামলাম। সেখান থেকে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে আমাদেও গাড়িগুলো চলতে লাগল। রাস্তার দুইপাশে সবুজ ফসলের ক্ষেত মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে। কখনো কখনো ছোট ছোট খাল, নদী বিল পেরোচ্ছি। রাস্তার পাশে ছোট ছোট বাড়িঘর গ্রামীণ পরিবেশের কৃষককুলকে খুবই সর্বংসহা সাধারণ মনে হলো।

দুই.
দুই লেনের রাস্তাটি নতুন করা হয়েছে। আর নতুন রাস্তা হওয়ার কারণে সাঁ সাঁ করে গাড়ি চলে যাচ্ছে ক্রমশ তীর্থস্থান টুঙ্গিপাড়ার দিকে। গোপালগঞ্জ যে স্বাধীনতার পরে সেখানকার বিশেষ কোন উন্নয়ন হয়নি তাতেই বুঝা যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় অসম উন্নয়ন পছন্দ করতেন না বলেই তিনি সবার আগে গোপালগঞ্জের উন্নয়ন করেননি। আর সেজন্যই ’৭৫ পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার আগে অন্য কোন সরকারই গোপালগঞ্জের কোন উন্নয়ন করেনি। রাস্তায় যেতে যেতে সেখানকার সাধারণ মানুষ দেখে সহজ সরল মনে হল। আর আমরা গাড়িতে আলাপ করছিলাম, বঙ্গবন্ধু তো আসলে এসব সহজ সরল গ্রামীণ মানুষের মধ্যে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন বলেই তিনি এত উদার হয়েছিলেন। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও তাই। রাস্তার দুপাশে সারি সারি পাট ক্ষেত। বাংলাদেশের যে কয়েকটি পাট সমৃদ্ধ জেলা রয়েছে তার মধ্যে গোপালগঞ্জ অন্যতম। দেখতে দেখতে চলে আসলাম বিখ্যাত সেই তীর্থস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া যেখানে গুমিয়ে আছেন শান্ত হয়ে আমাদের স্বাধীনতা দানকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমি নতুন বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স হওয়ার পর আর কখনো টুঙ্গিপাড়া যাইনি। প্রথমে সেখানে গিয়ে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সেখানকার সরকারি রেস্ট হাউজে উঠেছি। তখন সকাল এগারোটা। রেস্টহাউজে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে হালকা রিফ্রেশমেন্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জাতির জনকের সমাধি ও পুরো কমপ্লেক্স দেখার জন্য। এরইমধ্যে মাসুম হাওলাদার সাহেব তাঁর পূর্ব পরিচিত লোকজনদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সের পেশ ইমামের সাথে কথা বলে ঠিক নিয়েছেন যাতে আমরা বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পুষ্পস্তবক প্রদান এবং মাজার পরিদর্শন শেষে তিনি দোয়া পড়িয়ে মোনাজাত পরিচালনা করেন। সেখানে আমরা দলগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পন করি মোনাজাত পড়ি। অতঃপর সেখানকার গাইডের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর পৈত্রিক বাড়ির বিভিন্ন স্মৃতি, ছবি, স্থাপনা ঘুরে দেখি, ছবি তুলি এবং সেখানে রাখা শোক বইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ভাইস-চ্যান্সেলর মহোদয় তাঁর মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। এসময় আমরা সকলেই তাঁর পাশে ছিলাম।

ওখানে গেলে যেকেউ আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়বেন। প্রতিটি স্থানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর বাড়িঘরগুলোকে অক্ষত রাখা হয়েছে, তবে আংশিক সংস্কার করা হয়েছে। পাশে পুকুরের চারিপাশে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশবান্ধব গাছ-গাছালি দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তৈরী করা হয়েছে পানির ফোঁয়ারা। দেশ বিদেশে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর উপর বিভিন্ন প্রকাশনা নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে একটি উচ্চমানের লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটিতে এমন অনেক কিছুই রয়েছে যেগুলো শুধু ধানম-িতে ৩২ নম্বরে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরেই বিদ্যমান। পশেই রয়েছে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন একটি বড় মসজিদ যেখানে আমরাও যোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। এগুলো দেখতে দেখতে আমরা কখন যে একেকজন দলছুট হয়ে গেছি বলতেই পারবনা। তবে যেহেতু মোবাইলের যুগ সেকারণে মুহূর্তেই সবাই একত্রিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সবাই একসাথে হয়ে মাসুম হাওলাদার সাহেবের আতিথেয়তায় বঙ্গবন্ধুর আপনজন ও আওয়ামীলীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর এলাকার কিছু মানুষের সাথে আলাপ করে সেখান থেকে আজকের মতো ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

তিন.
আমরা পরেরদিন যাব মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের আরেক তীর্থস্থান মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার ভবেরহাটের বৈদ্যনাথতলার ঐতিহাসিক আ¤্রকাননে। তাঁর আগে রাতে যশোরে থাকব। তবে কোন বাণিজ্যিক হোটেলে নয়। যোগাযোগ করলাম বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের যশোর আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দের পরিচালকের সাথে। আমি একজন কৃষিবিদ এবং পূর্ব পরিচিত থাকায় তিনি আমাদের জন্য খুব সহজেই রাতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ট্রেজারার মহোদয়ের এক মেয়ের শশুরবাড়ি যশোর শহরে হওয়ায় তিনি সেখানে রাতে অবস্থান করলেন। আর ভাইস-চ্যান্সেলর মহোদয়সহ আমরা সকলে শহরতলীর সে কৃষি গবেষণা কেন্দ্রেই ভিআইপি মর্যাদায় থাকলাম। রাতে আমাদের এক সহকর্মী সৈকত সাহেবের জ্বর হলো এবং তাঁকে চিকিৎসা করানোর জন্য যশোর শহরে গিয়ে একটি চাইনিজ রেন্টুরেন্টে সন্ধ্যার নাস্তা সেরে নিলাম। আসার পথে কিছু লিচু কিনে নিয়ে এসে রাতের খাবারের পর সবাই একটি লনে বসে খোশ গল্পে মশগুল হলাম এবং ফাঁকে ফাঁকে সেই লিচুগুলো খেলাম। সকলে মিলে যশোরের সেইরাত ভালই কাটল। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ডিম ভাজি ও ভুনা খিচুরি দিয়ে নাস্তা সেরে সকাল ৯টায় মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি।
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি এবং সেটি হলো প্রথমে যশোর থেকে ঝিনাইদহ পরে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ইত্যাদি। রাস্তাটি বেশ পুরাতন কিন্তু মাঝেমধ্যে সংস্কারকার্য করা হয়েছে। পুরাতন রাস্তা হওয়ার কারণে রাস্তার দু’পাশে বেশ পুরাতন ও বড় বড় গাছের সারি যা দেখতে খুবই সুন্দর। খুব রোদ উঠেছে সেজন্য খুব গরম পড়েছে। এমন গরম যে গাড়ির এসিও যেন কুলোচ্ছে না। এগারোটার দিকে একবার রাস্তার মাঝে চা খেতে নামলাম। সেখানে চা খাওয়ার আগে ট্রেজারার মহোদয়ের মেয়ের বাসা থেকে নিজের হাতের বানানো কেক ও পিঠার স্বাদ গ্রহণ করলাম। বেশ ভালই লাগল। তারপর আবারো গাড়ি চলছে। মাঝখানে শুধু আরেকবার একটি ফিলিং স্টেশনে থামানো হলো রিফুয়েলিং করার জন্য এবং নিজেদের প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারার জন্য। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে মুজিবনগরে এসে পৌঁছালাম। সেখানে আগে থেকেই ভিআইপি রেস্টহাউজটি বুকিং দেওয়া ছিল। সময় বাঁচানোর জন্য আমরা সেখানে গিয়েই সরাসরি চলে যাই ইতিহাসভিত্তিক তৈরীকৃত মুজিবনগর কমপ্লেক্সে। সেখানে গিয়ে প্রতিটি স্থাপনা দেখে একেকটি তীর্থ মনে হয়েছে। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ অস্থায়ী সরকার গঠন থেকে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সেই প্রবাসী সরকারের শপথগ্রহণ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ধাপ আলাদা আলাদা করে স্ট্যাচুর মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

মূল জায়গাটিতে স্টেডিয়ামের মতো একটি স্ট্রাকচার তৈরী করা হয়েছে যেখানে বাংলাদেশের একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র বানিয়ে সেখানে কিভাবে ১১টি সেক্টরে কাদের নেতৃত্বে পুরো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়েছে, তার ধারাবাহিক ইতিহাস সুন্দরভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে। বাইরে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতা, ছয়দফা, ১১ দফা, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ ইত্যাদি প্রত্যেকটি দেখানো হয়েছে যা দেখলে এখনো জীবন্ত ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে। তার উত্তর দিকে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক আমবাগান যাকে ইতিহাসের আ¤্রকানন বলা হয়ে থাকে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা যেমন পলাশীর আ¤্রকাননে স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন, ঠিক তেমনি মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আ¤্রকাননও সেই ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতার সাক্ষ্য বহন করে। আমরা সেই মুজিবনগর সরকারের স্টেজটি দেখতে সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে যেই স্মৃতিসৌধটি দেখতে পাই তা ধেখে আপ্লুত না হয়ে পারা যায় না। সেদিন সেই সরকারের শপথ পাঠ করানোর জন্য কেন সেই ভারতের সীমান্তবর্তী আ¤্রকাননকে বেছে নেওয়া হয়েছিল? তার কারণ ছিল গোপনীয়তা এবং সমস্যা হলে যেন সহজেই বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেওয়া যায়। সেখানে পরিদর্শনের সময় ষাটোর্ধ বয়সের একজন গাইড খুব সুন্দর ও প্রাণবন্তভাবে আমাদের ইতিহাসের বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তারপর তাঁকে নিয়ে সবাই একটি ফটোসেসনে অংশ নিয়ে সেখান থেকে ফিরে রওয়ানা দিই।

চার.
আমের মৌসুম চলছে। দেখা যাচ্ছে গাছে গাছে অনেক আম কিন্তু সময়ের অভাবে আর তা খাওয়া সম্ভব হলো না। অস্থায়ী সরকারের স্মৃতিসৌধ থেকে বের হয়ে আমরা পূর্বে বুকিংকৃত রেস্ট হাউজে গিয়ে শুধু একটু ফ্রেশ হয়ে ও অল্প কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। এবার উদ্দেশ্য আমরা এরই মধ্যে দুপুরে আহারের আরেকটি দাওয়াত পেয়েছি। সেটির ব্যবস্থা করেছেন আমাদের সফরসঙ্গী হিসাব বিভাগীয প্রধান মো. নজরুল ইসলাম সাহেব, তাঁর সাবেক কর্মস্থল ও সহকর্মী পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে। তাঁরা আমাদের আগমণের খবর পেয়ে সবার জন্য বেশ ভালোভাবে দুপুরের খাবারের আয়োজন করলেন। আগেই বলেছি আমাদের সময় কম ভ্রমণ বেশি। সেজন্য কোন জায়গায় বেশি সময় অতিক্রান্ত না করে শুধু টাচ করে যাওয়া। এ পদ্ধতিতে আমাদের পরবর্তী টার্গেট হলো শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি পরিদর্শন এবং তৎপরবর্তীতে একই রাস্তায় যাওয়ার পথে ফকির লালন শাহের মাজার দেখে যাওয়া। পল্লী বিদ্যুতের ভদ্রলোকদের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি। সেখানে আরো একটি বাড়তি সুবিধা পাওয়া গেল। মুজিবনগরের আমবাগানে আম দেখে খাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেখানে সময়ের অভাবে খাওয়া যায়নি। কিন্তু এবার দুপুরের খাবারের পর তাঁরা সরাসরি আমের গাছ থেকে আমাদের আম পেরে খাওয়ালেন।

চলে গেলাম শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। সেখানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস, স্মৃতিময় জায়গা পরিদর্শন করছি। সেখানকার গাইডেরা আমাদেরকে প্রত্যেকটি জিনিস খঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর আমরাও অনেক তৃপ্তি পেয়েছি। তার কারণ আমরা জানি, নজরুল-রবীন্দ্র একে অপরের পরিপূরক। কাজেই নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর দেখলে আপ্লুত হবে সেটাইতো স্বাভাবিক। সেখানেও রবীন্দ্রনাথের সৃজিত গাছের বাগান দেখেছি, দেখেছি পদ্মা নদীতে তিনি যে নৌকায় চলতেন সেটি, দেখেছি পুকুরঘাট, সেখানে ভবঘুরে হিসেবে থাকা স্বভাব শিল্পীদলের কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্র নাথের গান, ‘যেদিন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাঁকে, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ এমন দুটি জনপ্রিয় গান। এ গানগুলো শুনে আমাদের টিমের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কিছু বকশিসও দিয়েছিলাম। প্রচ- ও বেজায় গরমের মধ্যে এমন ভ্রমণ সত্যিই কঠিন। সেজন্য কুঠিবাড়ির পাশে থাকা বাংলোয় আধাঘণ্টা পরিমাণ বিশ্রাম নিয়ে সামনে ভাসমান কয়েকটি মেলার পসরায় চোখ বুলিয়ে আবারো বেরিয়ে পড়লাম লালন ফকিরের দরগার উদ্দেশ্যে।

পাঁচ.
লালন ফকিরের দরগায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সেখানে গিয়ে আগে ট্রেজারার ও নজরুল সাহেবকে নিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ পড়ে লালনের দরগায় ঢুকে সেকি অবস্থা! সেখানে যেসব ভক্তরা যাতায়াত করে তাদেরকে মুরিদান ও ফকির বলে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। রাত-দিন চলে সেখানে গানের ও ফকিরীর আসর। সেই আসরে নিত্য-নৈমিত্তিক গঞ্জিকা সেবনে বসেন ভক্তরা। সবচেয়ে বড়কথা হলো সকল ধর্মের মানুষই সেখানে যাতায়াত করে থাকে। কারণ লালন নিজেকে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের বলে পরিচিত করেননি। তিনি তাঁকে মানুষ পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। দেখা গেল সেখানে ভক্তদেরও বিভিন্ন ক্যাটাগরি রয়েছে। একধরনের ভক্ত আছেন যারা দিনে এসে দিনেই ঘুরে চলে যায়। কিছু ভক্ত আছেন যারা স্থায়ীভাবে সেখানে থাকেন মাজারের খেদমতদার হিসেবে। কিছু ভক্ত সেখানে আসেন যারা মৌসুমী জলসা সেরে চলে যান। আর দৈনন্দিন আমাদের মতো পরিদর্শনে আসা ভ্রমণকারী তো রয়েছেই। দরগার মাজারে গিয়ে দেখি মূল সমাধিতে খাদেমদার কেউকেউ মাজার মুছামুছি করছেন, কেউ আবার আগুন্তুকদের বিভিন্ন বিষয়ে বর্ণনা করছেন, আবার কেউবা আগরবাতি, মোমবাতি, ধোপ ইত্যাদি জ¦ালাচ্ছেন।

পাশের একটি বিল্ডিংয়ের নিচে দেখলাম কয়েকজনে লালন সাঁইজির গানের সুর সাধছেন। আমরা কাছে গিয়ে দেখলাম তাদের মধ্যে একজন কালো, ক্ষীণকায় লম্বাটে ধরনের মহিলা। পরে তাঁকে আবিষ্কার করলাম কাঙ্গালিনী সুফিয়া হিসেবে। আমরা আমাদের পরিচয় দিতেই খুবই খুশি হলেন সুফিয়া। অনুরোধ করতেই একের পর এক গান গাওয়া শুরু করলেন তিনি। তাঁর গানে মত্ত হয়ে আমরা আর রাতের গভীরতা টের পাইনি। কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে একটু সচেতন ¯্রােতা মাত্রই চেনেন। কারণ তিনি রেডিও-টেলিভিশনে নিয়মিত বাউল ও আধ্যাত্মিক গান করে থাকেন। তবে লালনের ভক্ত হিসেবে তিনি বেশিরভাগ সময়ই এ দরগাতেই কাটান। শুনলাম এবং বুঝলাম তিনি এখন ভালো নেই। তাঁর শারীরিক অবস্থাই বলে দিচ্ছে কাঙ্গালিনী ভাব। তিনি শুধু নামেই নন আসলেই কাঙ্গালিনী। দেখলাম গান গাইতে গাইতে তাঁর তাল উঠে গেছে। কিন্তু আমাদের ফিরতে হবে আজই। সেজন্য আর সময় না দিয়ে তাঁর গান থামিয়ে সবাই মিলে তাঁকে বড় ধরনের কিছু বকশিস দিয়ে আমরা আবার ফিরে আসার জন্য দরগা থেকে বের হই। বের হয়ে সেখানকার প্রতিদিনকার বসা মেলা থেকে আমার দুই ছেলে নাফি ও তকির জন্য লালনের প্রতীক হিসেবে দুটি একতারা কিনে নিয়ে সকলে একসাথে হয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি।

পথিমধ্যে লালন সেতু পেরিয়ে ঈশ্বরদী মোড়ে এসে নতুন আরেক সিদ্ধান্ত হলো। সেখানে জানা গেল ভিসি মহোদয়ের গাড়ির ড্রাইভার নজরুলের ছোটভাই মনিরের বিয়ে। মনিরও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করছে। আবার আমাদের সফরসঙ্গী আব্দুল হালিম সাহেবে বাড়িও আবার পাবনা শহরে। সেখানে মনিরের বিয়ের এবং হালিম সাহেবের বাসায় বেড়ানোর দাওয়াত দেওয়া হলো। আমরা কারা কারা যেতে পারব আর কারা কারা যেতে পারব না- সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ঈশ্বরদী মোড়ে বসে চা খেলাম এবং আলাপ করলাম। আমি এবং নজরুল সাহেব ছিলাম ট্রেজারার মহোদয়ের গাড়িতে। তিনি জটিকা ভ্রমণে শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ বোধ করায় আমাদের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত তাঁদের বাকী ভ্রমণ সম্পন্ন করার এজাজত দিয়েই আমরা চলে আসি। রাস্তায় যমুনা বঙ্গবন্ধু ব্রিজের পশ্চিমপাড়ে হানিফ রেস্ট হাউজে এসে রাতের খাবার খেয়ে নেই। তারপর সেখান থেকে রওয়ানা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ব্রিজ চোখের পলকে পাড়ি দিয়ে মধুপুরের গড়ের ভিতর দিয়ে আধা আলাপে আধা ঘুমে রাত তিনটায় এসে ময়মনসিংহ শহরের বাসায় পৌঁছে সেই জটিকা তীর্থ ভ্রমণের যবনিকাপাত ঘটিয়েছিলাম। মঝেমধ্যেই সুযোগ পেলে এমন জটিকা ভ্রমণ নিয়ে দেশীয় গুরুত্বপূর্ণ এসব তীর্থস্থানগুলো দর্শন করা উচিত।

লেখক: ড. মো. হুমায়ুন কবীর, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer