Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

দেশে ৪০ মিলিয়ন মানুষ পুষ্টিহীনতায় : অধ্যাপক রহিম

মো. আউয়াল মিয়া, বাকৃবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ৭ এপ্রিল ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

দেশে ৪০ মিলিয়ন মানুষ পুষ্টিহীনতায় : অধ্যাপক রহিম

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

ময়মনসিংহ : বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষক, গবেষক ও বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম বলেছেন, দেশে ৪০ মিলিয়ন মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

তিনি বলেন, দেশের মানুষ শুধু পেট ভরে ভাতই খায়। তারা সুষম খাবার বোঝে না। প্রতিদিন মানুষের ১২০ গ্রাম ফলমূল ও ২০০ গ্রাম সবজি খাওয়া দরকার হলেও তারা তা পাচ্ছেন না। ফলে দেশে এখনো ৪০ মিলিয়ন লোক নীরব দুর্ভিক্ষে (পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতা) ভুগছে।

সম্প্রতি বহুমাত্রিক.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম।

দেশের কৃষি গবেষণা, বিশেষ করে ফল গবেষণায় অনন্যমাত্রা এনে দেওয়া এই গবেষক অসংখ্য ফসলের জাত উদ্ভাবন করে যেমন খাদ্যনিরাপত্তায় বড় অবদান রেখেছেন, একইসঙ্গে বিলুপ্তপ্রায় ফলের জাত সংরক্ষণেও রেখেছেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা।

গবেষণাকেই জীবনের অংশ করে নেওয়া এই গবেষক তিন দশকের বেশি সময় ধরে সক্রিয়ভাবে গবেষণা করে চলেছেন। উপহার দিয়েছেন বাউকুল, আম, পেয়ারা, লেবু,জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, জলপাই, আমলকি,ডুমুর, মালটা, অরবরই, লটকন, স্ট্রেবেরী, কদবেল, কাঁঠাল, আমড়া, রামবুটান, কাজুবাদাম, ড্রাগন, লিচু, তেতুঁল, লংগান, সফেদারসহ বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী ফলসহ মোট ৮১ প্রজাতি।

একাধারে তিনি ময়মনসিংহে অবস্থিত দেশের কৃষি গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক ও প্রধান রূপকার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত গুণী এই গবেষকের সঙ্গে বাংলাদেশের ফল উৎপাদনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ এখানে তুলে ধরা হচ্ছে-

বহুমাত্রিক.কম এর পক্ষ থেকে অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম এর সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. আউয়াল মিয়া।

বহুমাত্রিক.কম : ফল গবেষণায় আপনার দীর্ঘ পথচলার গল্প শুনতে চাই। আপনার নেতৃত্বে গড়ে উঠা বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার ও এর সঙ্গে জড়িত অন্যদের বিষয়েও জানতে চাই-

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : বিদেশী ফলের আগ্রাসনে ও উদ্ভাবিত নতুন জাতের প্লাবনে আমাদের দেশী ফলগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। দেশীয় ফলকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে, দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই আমাদের গবেষণার বিষয়। বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার বা ফল জাদুঘর, বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড কো-অপারেশন অর্থায়নে ইন্টার কোঅপারেশন-এগ্রো ফরেস্ট্রি ইমপ্রুভমেন্ট পার্টনারশিপ এর ব্যবস্থাপনায় এ ফল জাদুঘরটি গোড়াপত্তন হয় ১৯৯১ সালে। তখন প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ফ্রুট ট্রি স্টাডিজ, পরবর্তীকালে এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়, ফল উন্নয়ন প্রকল্প, এখন এটাকে ফলদ বৃক্ষের “ জার্মপ্লাজম সেন্টার” বলা হয়। বর্তমানে এ সেন্টারটি বাংলাদেশে তথা এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফলদ বৃক্ষের সংগ্রহশালা।

বর্তমানে এ প্রকল্পটির অর্থায়ন করছে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড কো-অপারেশন অর্থায়নে ইন্টার কোঅপারেশন এএফআইপি। ১৯৯১ সনে প্রকল্প মাত্র এক একর তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে কর্মমুখর হয়ে উঠে, যার ফলাফল ক্রমেই ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। বর্তমানে এর আয়তন ৩২ একর। বর্তমানে এ গবেষণার সঙ্গে অধ্যাপক ড. মো. হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক ড. মো. মোক্তার হোসেন, ড. মো. শামসুল আলম মিঠু, পিএইচডি ও মার্স্টাসের ছাত্র-ছাত্রীরাও জড়িত।

বহুমাত্রিক.কম : ফল গবেষণার এ প্রকল্পটি কত বছর মেয়াদী? গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আরও কোন স্থান কী রয়েছে?

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : ১৯৯১ সাল থেকে অদ্যাবধি এ গবেষণা চলছে। এটা আসলে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতেই আমাদের গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছি।

বহুমাত্রিক.কম : যে উপলব্ধি থেকে আপনি এই গবেষণা শুরু করেছিলেন-এই সময়ে এসে সেবিষয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই-

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : ফলের বীজ ব্যাংক তৈরি, দেশীয় ফলকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা এবং দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা নিশ্চিত করতেই গবেষণা শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত ৮১ টি জাত উদ্ভাবন করেছি। খরা, তাপ, বন্যা ও লবণ সহিষ্ণুজাত উদ্ভাবনের চেষ্টায় রয়েছি। আশা করি সফল হব।

বহুমাত্রিক.কম : বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার গবেষণায় কতটুকু সফল হয়েছে বলে মনে করছেন?

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : আমি মনে করি এখন পর্যন্ত সফল। আমরা যে জাতগুলো উদ্ভাবন করেছি তা মাঠ পর্যায়ে খুব ভাল ফলাফল দিচ্ছে। আমরা অর্গানিক ফল ও শাকসবজির প্রতি অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। সেই সাথে স্বল্প সময়ে ও স্বল্পব্যয়ে কীভাবে ফল ও শাক সবজি উৎপাদন করা যায় সেই দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছি। বাউকুল বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনেক অবদান রাখছে। বিশ্বের ২৭ টি দেশে বাউকুল চাষ করা হচ্ছে। মনে করি এটি একটি বড় সাফল্য।

বহুমাত্রিক.কম : সাফল্যের প্রথম সারিতে যেসব গবেষণাকে রাতে চান আপনি-

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : বাউকুল, আম, পেয়ারা, লেবু, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, জলপাই, আমলকি,ডুমুর, মালটা, অরবরই, লটকন, স্ট্রেবেরী, কদবেল, কাঁঠাল, আমড়া, রামবুটান, কাজুবাদাম, ড্রাগন, লিচু, তেতুঁল, লংগান, সফেদারসহ এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী ফলসহ মোট ৮১ প্রজাতি উদ্ভাবন করেছি। বিভিন্ন বিদেশি ফল প্যাসন ফল, জাবাটিকাবা, শানতোল, রাম্বুটান, লংগান, ম্যাঙ্গোস্টিন, সিডলেস লিচু, ডুরিয়ান, এভোকেডো ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে ভবিষ্যতে এ দেশে নতুন জাত হিসেবে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টায় আছি। বর্তমানে এখানে ৪৯টি দেশের প্রায় ৫৮টি ফল ও ফল গাছের ওপর গবেষণা করা হচ্ছে। এছাড়াও আলু,কলা, কচু ও গাজর নিয়ে কাজ করছি।

বহুমাত্রিক.কম : পুষ্টিনিরাপত্তা ও সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আপনার এসব গবেষণা নি:সন্দেহে সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক ফল বয়ে আনছে। আপনার মূল্যায়ন কী?

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়, গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থান, মাঠ পর্যায়ে ফলাফল ভাল, আয়ের উৎস বাড়ানোসহ গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে এসব গবেষণা। দেশীয় প্রধান ও অপ্রধান ফলগুলো উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের ফল আমদানি কম করতে হচ্ছে।

বহুমাত্রিক.কম : শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গবেষণাটির প্রক্রিয়া কিভাবে চলছে?

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দেশের প্রচলিত ও বিলুপ্ত প্রায় ফলের গাছ সংগ্রহ করে স্বল্প সময়ে কম ব্যয়ে বেশি উৎপাদন করার লক্ষ্যেই আমরা শুরু থেকে কাজ করছি। দেশীয় আবহাওয়া উপযোগী ও অর্থনৈতিক লাভজনক করাই আমাদের উদ্দেশ্য।

বহুমাত্রিক.কম : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষি গবেষণাগুলোর গুরুত্ব কতখানি-

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : আমাদের দেশের মানুষ শুধু পেট ভরে ভাতই খায়। তারা সুষম খাবার বোঝে না। প্রতিদিন মানুষের ১২০ গ্রাম ফলমূল ও ২০০ গ্রাম সবজি খাওয়া দরকার। এদেশে এখনো ৪০ মিলিয়ন লোক নীরব দুর্ভিক্ষে বা পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আমরা এই সমস্যাগুলো কমানোর চেষ্টায় আছি। সেই সাথে বাংলাদেশ যাতে ধানের পাশাপাশি ফলমূল ও শাকসবজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

বহুমাত্রিক.কম : এই নীরব দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ জানতে চাই-

অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম : বৃক্ষ মানবের পরম বন্ধু। শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে প্রতিনিয়ত আমরা এই পরম বন্ধুকে হারিয়ে ফেলছি। মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৃক্ষের উপর নির্ভরশীল। বৃক্ষ আমাদের জীবনধারনের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহের পাশাপাশি ফলদিয়ে আমাদের পুষ্টি ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করে। আমাদের এই পরম বন্ধুকে আগলে রাখতেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ফলজ গাছের সমৃদ্ধ বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার বা ফল জাদুঘর। শুরু থেকেই দেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত নানা ফলদ বৃক্ষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং বিদেশি ফলের ওপর গবেষণা চালিয়ে এদেশে উৎপাদন উপযোগী জাত উদ্ভাবনের নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছি।

চাহিদার তুলনায় আমাদের দেশে গবেষণা একবারেই অপ্রতুল। আরো গবেষণা ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। যাতে অধিক জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করা যায়। আমাদের উদ্ভাবিত জাতগুলো যাতে প্রান্তিক কৃষকের হাতে পৌঁছাতে পারে সেই ব্যাপারে সরকারের সহযোগীতা কামনা করছি। সেই সাথে গবেষণার জন্য অধিক বাজেট বরাদ্দ ও বৃদ্ধি করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করছি।

প্রতিবেদক মো. আউয়াল মিয়া

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer