Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

‘টেস্ট বাণিজ্যের পক্ষে ছিলাম না বলেই দেশ ছাড়তে হয়’

শওকত আলী বেনু

প্রকাশিত: ১৮:৩৯, ৪ মার্চ ২০১৭

আপডেট: ০১:৪৬, ৬ মার্চ ২০১৭

প্রিন্ট:

‘টেস্ট বাণিজ্যের পক্ষে ছিলাম না বলেই দেশ ছাড়তে হয়’

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

প্রবাসী কবি ও চিকিৎসক ক্যাপ্টেন (অব:) গোলাম নবী চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন পূর্ব লন্ডনের বো এলাকায়। প্রবাসী এই নিউরোলোজিস্ট অবসর জীবনেও বেশ রোমান্টিক, কথা ও ভাবনায়।

কুষ্টিয়ার গোসাইন দুর্গাপুরের আড়পাড়া গ্রামের আব্দুল আজিজ চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র নবী চৌধুরী’র সাথে বহুমাত্রিক.কম এর পক্ষে কথা বলেছেন সম্পাদক শওকত আলী বেনু।

আলাপচারিতার প্রথমপর্বের(প্রবাসী কবি ও চিকিৎসক নবী চৌধুরীর জীবনের কথকথা) পর পরবর্তী অংশ তুলে ধরা হলো দ্বিতীয় পর্বে।

ক্যাপ্টেন (অব:) গোলাম নবী চৌধুরী ১৯৬৯ সালে পাড়ি দেন যুক্তরাজ্যে। জানালেন যুক্তরাজ্যে এসে শুরুটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। লেখাপড়া এবং চাকরি দু’টিই করেছেন একসঙ্গে। প্রথমে পূর্ব লন্ডনের মাইলএন্ড হাসপাতাল এবং পরে রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালে টেম্পোরারি জব খুঁজে নিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি কুইন স্কোয়ার, লন্ডন থেকে নিউরোলজিতে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।

পরবর্তীতে ব্রিস্টল রয়্যাল ইনফার্মারি (বিআরআই) হাসপাতালে চাকরি নেন। সেখানে হাউস অফিসার, সিনিয়র হাউস অফিসার এবং সিনিয়র রেজিস্ট্রার পদসহ প্রায় ৭ বছর কাজ করেন। এরপর কনসালটেন্ট পদে রয়্যাল লিভারপুল হাসপাতালেও কিছুদিন কাজ করেন।

বহুমাত্রিক.কম : দীর্ঘ পেশাগত জীবনে আর কোথায় চাকরি করেছেন?

নবী চৌধুরী : ১৯৮৬ থেকে ৯২ পর্যন্ত তিনি জার্মানিতে ছিলাম।জার্মানির মুনস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে নিউরো প্যাথলজিতে পোস্টগ্রাজুয়েশন শেষ করে ওখানেই ২ বছর শিক্ষক হিসাবে যুক্ত ছিলাম।  

বহুমাত্রিক.কম : তারপর?

নবী চৌধুরী : এরপর শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়। মাটির টানে ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরি। পেশাগত জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা কাজে লাগিয়ে চেয়েছিলাম দেশের নাগরিকদের সেবা করতে। সেই লক্ষ্যে ঢাকার উত্তরায় প্রতিষ্ঠা করি মায়ের নামে নুরজাহান ক্লিনিক। একইসঙ্গে কাজ করি চট্টগ্রাম লায়ন্স জেনারেল হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসেবে। খুলনা ও যশোরেও কাজ করেছি। চেষ্টা করেছি সৎভাবে জীবনযাপন করতে। যখনি হোঁচট খেয়েছি কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে চায়নি। অনেক বৈরী অভিজ্ঞতায় ২০০৫ সালে আবার লন্ডন ফিরে আসি।

বহুমাত্রিক.কম : দেশ ছেড়ে আবার বিদেশে পাড়ি জমানোর পেছনে ঠিক কী কারণ ছিল ?

নবী চৌধুরী : সে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। ভাবছিলাম দেশেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো। মানুষের সেবা করবো। তা আর হলো কই? মায়ের নামে ঢাকার উত্তরায় একটি ক্লিনিক দিয়েছিলাম। দুষ্ট লোকদের অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে আর চালাতে পারলাম না। কী করবো, একটা কিছু করে তো বাঁচতে হবে। তাই আবার বিদেশেই চলে এলা।

বহুমাত্রিক.কম : কিসের নির্যাতন? বিস্তারিত বলবেন কী?

নবী চৌধুরী : ডাক্তারি একটি মহান পেশা। আপনি জানেন, রোগীর রোগ নির্ণয়ের জন্যে প্যাথলজি টেস্ট অনিবার্য।বিশেষ কিছু রোগ শনাক্ত করতে হলে অবশ্যই প্যাথলজি টেস্ট করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রোগী ক্লিনিকে আসলেই ‘টেস্টবাজি’ করে গরিবের রক্তচোষে চিকিৎসা করতে হবে এমনটা তো কথা নেই! আমি গরিবের গলা কেটে চিকিৎসা করবো সেটা তো হতে পারে না। সেবা করার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হলো না।

বহুমাত্রিক.কম : কেন হলো না?

নবী চৌধুরী : আমি খুব কম পয়সায় রোগীদের চিকিৎসা করতাম, আমার ক্লিনিকে। কী ভাবে করতাম সেটা বলছি। আমার এখানে রোগী এসে অল্প পয়সায় ভালো হয়ে যেত। এতে করে আমার ক্লিনিকে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলো। খামোখা রোগীকে বাড়তি টেস্ট আমি করতে দিতাম না।টেস্ট বাণিজ্য করে গলাকাটা ফি রাখার পক্ষে আমি ছিলাম না। আমি ক্লিনিকের মালিক হলেও আমি একজন ডাক্তার। লেখাপড়া এবং প্র্যাকটিস করে এটাতো বুঝে গেছি কোন রোগীকে টেস্ট করতে দেয়া দরকার। সাধারণ সর্দি-কাশি নিয়ে আসলেও কী এইসবের দরকার আছে? এটাই ছিল আমার অপরাধ।

বহুমাত্রিক.কম : অপরাধ কেন?

নবী চৌধুরী : আমি অন্য ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ি। বিশাল সিন্ডিকেট। প্রতিযোগীদের কাছ থেকে অনেক চাপ আসে। তাঁদের এককথা, রোগীকে ক্লিনিকে আসলেই টেস্ট করতে দিতে হবে। এটা নিয়ে প্রতিবাদ করায় শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এই নিয়ে ‘কালা জাহাঙ্গীর’ নামে এক গুণ্ডাও লেলিয়ে দেয় আমার ক্লিনিকে। বাসায় এসেও আক্রমণ করে। সেই অনেক কথা। এইগুলো এখন বলে আর কী হবে?

বহুমাত্রিক.কম : তারপর?

নবী চৌধুরী : এতো অত্যাচারের মাঝে কী থাকা যায়? বলুন। সব ছেড়ে ফেলে দিয়ে আবার চলে আসি লন্ডনে। ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। এর মাঝে ২ মেয়ে ও ১ ছেলে বাংলাদেশে থাকেন। দেশে বসবাসরত ২ মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছি। জ্যেষ্ঠ মেয়ের স্বামী মেজর (অবঃ) নাসের খান। বড় ছেলে ঢাকায় ব্যবসা করেন।

বাকি ২ ছেলে ১ মেয়ে আমার সাথে লন্ডনেই। ছেলে নাঈম চৌধুরী এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সিটি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনার পাশাপাশি গণিত বিষয়ে গ্রিনউইচ ইউনিভার্সিটিতে বিএ অনার্স করছে। দ্বিতীয় ছেলে নঈম চৌধুরী ‘এ লেভেল’ এ পড়ছে। ছোট মেয়েও বিয়ে দিয়েছি। 

বহুমাত্রিক.কম : আপনার শৈশব সম্পর্কে কিছু বলেন-

(প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়েন। ডাকতে থাকেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে। চলে আসেন স্ত্রী আফরোজা চৌধুরী। পরে বুঝতে পারি তিনি কেঁদেছেন।)

স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নবী চৌধুরী : ‘দেখতো, আমাকে বলছে শৈশবের গল্প বলতে। তুমিই বলে দাও না।

বহুমাত্রিক.কম : তিনি জানবেন কী করে?

আফরোজা চৌধুরী : হ্যা, আমি সব জানি। শৈশবে তিনি এতটাই দুরন্ত এবং অশান্ত ছিলেন যে, সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়াতেই তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্না থামাতে পারেননি।

নবী চৌধুরী : শৈশবের দুরন্তপনার স্মৃতি মনে হলে কঠিন ভাবে নাড়া দেয় আমাকে। মা’কে ফাঁকি দিয়ে অনেক দুষ্টুমি করেছি। মায়ের হাতে মার খেয়েছি কতো। তবু দুষ্টুমি কমেনি। সেই স্মৃতি মনে হলে শুধু কষ্টই বাড়ে।

এইসব নিয়ে তাঁকে কেউ কোনোদিন এমন প্রশ্ন করেনি। শুনতে চায়নি শৈশবের হারানো সেই স্মৃতি। এই প্রথমবার কেউ জানতে চাইলো ফেলে আসা দুরন্তপনার কথা।

বহুমাত্রিক.কম : কেন? ছেলে-মেয়ে, নাতি নাতনিদের সাথে গল্প করেননি? তাঁরাও জানতে চায়নি?

নবী চৌধুরী : ‘এখনকার ছেলে-মেয়েরা কী আর ওই সব বুঝে! তাঁদের ইন্টারেস্টও নেই। (চলবে)

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer