Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

টাটা কারখানার ধর্মঘট মিটিয়েছিলেন নেতাজি

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ০২:৪১, ১৩ আগস্ট ২০১৬

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

টাটা কারখানার ধর্মঘট মিটিয়েছিলেন নেতাজি

ঢাকা : এক সময় জামশেদপুরে টাটা স্টিল কারখানার ধর্মঘট মিটিয়েছিলেন খোদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু৷ ১৯২৮ সালে সেই ধর্মঘটের পর আর ওই কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হয়নি বলেই বার বার দাবি করতে দেখা যায় কর্তৃপক্ষকে৷ তার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে কারখানায় সম্প্রীতি রয়েছে দাবি করে পরবর্তীকালে ৫০ বছর কিংবা ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব পালন করতেও দেখা গিয়েছে৷

টাটা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯২৮ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত টানা ন’ বছর ধরে জামশেদপুরে টাটা স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র৷ এ কথা জানিয়ে ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট নেতাজির ১১৪তম জন্মদিনে টাটা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বেশ কিছু নথি ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল৷ পরের দিন সেই বিষয়ে সংবাদপত্রের রিপোর্টও মনে করিয়ে দেয়, ১৯২০ সালে গঠিত ওই ইউনিয়নের তৃতীয় সভাপতি ছিলেন সুভাষচন্দ্র৷

ওই সময় সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে বিদেশিদের বদলে দেশের লোকেদের বসানোর জন্য টাটা কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি তুলে তা আদায় করতে সক্ষমও হন নেতাজি৷ ১৯২৮ সালের ১২ নভেম্বর টাটা স্টিলের তৎকালীন চেয়ারম্যান এনবি সাকলাতওয়ালাকে চিঠি দেন সুভাষচন্দ্র ৷ সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘‘এই কোম্পানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল উচ্চপদে কোনও ভারতীয় নেই৷ আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, যদি টাটা স্টিল ভারতীয়করণ নীতি নিয়ে এগিয়ে চলে তবে আপনারা আপনাদের ভারতীয় কর্মচারীদের পাশাপাশি গোটা দেশ ও দেশের বিভিন্ন মতাদর্শের নেতাদের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হবেন৷’’

এর কিছু দিন পরেই টাটা স্টিল পেয়েছিল তাদের প্রথম ভারতীয় জেনারেল ম্যানেজারকে৷ পাশাপাশি নেতাজিই চাপ দিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি আদায় করাতে পেরেছিলেন৷ তাছাড়া ১৯৩৪ সালে শ্রমিকদের দাবি মতো প্রথম মুনাফাভিত্তিক বোনাস চুক্তি সম্পাদন হয়েছিল৷ সাকলাতওলার উপস্থিতিতে সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন টাটা স্টিলের জেনারেল মানেজার সিএ আলেকজান্ডার এবং নেতাজি৷

এরই পাশাপাশি ঐতিহাসিক দিলীপ সিমিওনকে টাটার কারখানা ইতিহাসের কালো দিকগুলি তুলে ধরতে দেখা গিয়েছে ৷ ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা The Politics of Labour Under Late Colonialism – Workers, Unions and the State in Chota Nagpur 1928-1939 বইটি৷ বইটির পাশাপাশি ইন্টারনেট থেকে পাওয়া এই ঐতিহাসিকের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে টাটাদের সম্পর্কে নেতাজির অসন্তোষের দিকটাও৷

এই ঐতিহাসিকই মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯২০-র দশকে টাটা স্টিলে অসন্তোষের ফলে এক শ্রমিক নেতার আবির্ভাব ঘটে৷ তাঁর নাম মানেক হোমি৷ এই মানেক হোমির বাবা ছিলেন টাটাদের কারখানার মেকানিক্যাল ফোরম্যান এবং কোনও গণ্ডগোলের কারণে তিনি টাটার কারখানা থেকে বরখাস্ত হন৷ যুবক মানেক হোমি তখন আমেরিকায় পড়তে গিয়েছিলেন৷ প্রতিহিংসাবশত মানেক হোমিকে টাটারা কোনও আর্থিক সাহায্য দেয়নি এবং এদেশে ফিরলে তাঁকে চাকরিতেও নেয়নি৷

প্রথমে বাবা ও তার পর তাঁর সঙ্গে এহেন বৈরি আচরণ দেখে যুবক মানেক হোমি ক্রমশ টাটা-বিরোধী হয়ে পড়েন এবং বিভিন্ন প্রকারে টাটাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন৷ ওই সময় কর্তৃপক্ষের উপর অসন্তুষ্ট শ্রমিকদের একাংশ হোমিকেই তাঁদের প্রতিনিধি হিসাবে বেছে নেন৷ ১৯২৮ সালে যখন কারখানায় ধর্মঘট শুরু হয় তখন শ্রমিকরা ম্যানেজমেন্টকে জানিয়ে দেন, তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে হোমির সঙ্গে কথা বলতে হবে৷ কিন্তু মানেক হোমিকে বহিরাগত বলে দাগিয়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি টাটা কর্তৃপক্ষ৷

এই পরিস্থিতিতে হোমিকে একেবারে জামশেদপুর লেবার অ্যাসোসিয়েশন (জেএলএ)-র নেতা হিসেবে জিতিয়ে আনার কথা ভাবতে থাকেন শ্রমিকদের একাংশ৷ ওই সময়ে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের (এআইটিইউসি) সম্পাদক সিএ অ্যান্ড্রুজ জামশেদপুর যান এবং শ্রমিক ইউনিয়নের ভোট স্থগিত করে দেন৷ কারণ তাঁদের কাছে ওই ধর্মঘট বড্ড বেশি জঙ্গি বলে মনে হয়েছিল৷ আর টাটা ম্যানেজমেন্ট ওই ধর্মঘট সমর্থকদের পিছনে কমিউনিস্টদের মদত রয়েছে বলে আশঙ্কা করেছিল৷

এই পরিস্থিতিতে জামশেদপুরের সংকট মেটাতে সর্বভারতীয় নেতারাও চেয়েছিলেন সুভাষ বসু ওখানে যান৷ সুভাষচন্দ্রের মধ্যস্থতাতেই অবশেষে সমাধানসূত্র বের হয় এবং কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে টাটা কর্তৃপক্ষের চুক্তি সাধিত হয়৷ সেই সমঝোতাকে সেরা চুক্তি বলে সুভাষচন্দ্র বসু দাবি করলেও শ্রমিকরা কিন্তু পুরোপুরি খুশি হতে পারেননি৷ কারণ তখন বেতন, ছাঁটাই ইত্যাদি নিয়ে অসন্তোষ ছিল শ্রমিকমহলে৷

এদিকে সুভাষচন্দ্র বসু জেএলএ নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর ধর্মঘট-সমর্থকদের নিয়ে মানেক হোমি জামশেদপুর লেবার ফেডারেশন (জেএলএফ) গঠন করেন এবং তা খুবই জনপ্রিয় হয় ৷ ফলে সেখানে শ্রমিক সংগঠন ঘিরে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়৷ এই অবস্থায় কিছু দিন পরে হোমির বিরুদ্ধে ইউনিয়নের টাকা নয়-ছয়ের অভিযোগ দায়ের হয়৷ পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলাও ঠোকা হয়েছিল৷ শোনা যায়, হোমি সকলের জন্য গ্র্যাচুইটি এবং পেনশনের দাবি তোলায় তাঁর বিরুদ্ধে একদল শ্রমিককে খেপিয়ে দিয়েছিল টাটা কর্তৃপক্ষই৷ কারণ সেই সময় বেছে বেছে কিছু লোককে এই সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছিল টাটা স্টিল৷ মানেক হোমি তার বিরোধিতা করাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে টাটা কর্তৃপক্ষ৷ অবশেষে জেলও হয় হোমির৷

এর কিছু দিন পর, ১৯৩০-এর দশকের গোড়ায় জামশেদপুরে গিয়ে হোমির সমর্থকদের সামনে সুভাষচন্দ্রও স্বীকার করতে বাধ্য হন, ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টাটারা শ্রমিক নেতাদের শেষ করছে৷ শুধু তাই নয়, ওই সময় তিনি এই মন্তব্যও করেন, বিভিন্ন কাপড়ের মিল মালিকদের তুলনায় টাটারা কম দেশপ্রেমিক৷ অর্থাৎ, ১৯২৮ সালের সাপেক্ষে তখন টাটা-সুভাষচন্দ্র সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল৷ ‘প্রিয় নেতা’ সুভাষচন্দ্র এভাবে ফুঁসে ওঠায় টাটা কর্তৃপক্ষও ভয় পেয়ে যায়৷

এমনকী, নেতাজির মিটিং ভণ্ডুল করতে তারা গুন্ডাও লেলিয়ে দেয়৷ জানিয়েছেন ঐতিহাসিক দিলীপ সিমিওন৷ আবার এই ইতিহাসবিদই জানাচ্ছেন, ১৯৩৯ সালে জামশেদজি টাটার শতবর্ষ স্মরণ অনুষ্ঠান শ্রমিকদের বয়কট করতে বলেছিলেন বিহার কংগ্রেসের তদানীন্তন জনপ্রিয় নেতা আবদুল বারি৷ কিন্তু ওই অনুষ্ঠান সমর্থন করতে বলেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ যা জানার পর অবাক হয়ে বারি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘সুভাষবাবু কি তাঁর আট বছর আগের বক্তব্যের কথা ভুলে গিয়েছেন?’’

সূত্র: কলকাতা২৪

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer