Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

জাতীয় পাট দিবস : আবারো জাগছে ‘সোনালী আঁশ’

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ১১:৫৯, ৬ মার্চ ২০১৮

আপডেট: ১১:৫৯, ৬ মার্চ ২০১৮

প্রিন্ট:

জাতীয় পাট দিবস : আবারো জাগছে ‘সোনালী আঁশ’

ছবি : ফাইল ছবি

পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক আভিজাত্যের সাথে সম্পৃক্ত একটি অনন্য সম্ভাবনার শিল্প নাম। একসময় পাট ছিলো আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রধানতম অর্থকরী ফসল। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বর্ষায় নৌপথে চলাচলে দেখা যেত পাট ক্ষেতে পানি আর বাতাসের ঢেউ দোলানোর খেলা। পাকিস্তান আমলে দেশের প্রধান রফতানিজাত পণ্য পাট ছিলো এদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তখন পাট এবং পাটজাত দ্রব্যের কারখানা স্থাপনে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছিলো। গ্রামে-গঞ্জের হাটগুলো তখন দেখা যেত পাটের স্তুপের টাল। সেই পাট শিল্প মুখথুবকরে পড়েছিলো অনাদর, অবহেলায়।

তবে আশার খবর হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় ৫ দশকের দ্বারপ্রান্তে এসে ক্রান্তিকাল পেরিয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাট শিল্প। বাংলার পাট আবারো নতুন সম্ভাবনার মুখ দেখছে। পাট উৎপাদনের বিবেচনায় ভারতের পরে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। এখনো পাট উৎপাদনকারী পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পাটের মান সবচেয়ে ভাল। গ্রিন ইকোনমি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ন্যাচারাল ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা ও সরকারের নানামুখি পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের নতুন সম্ভাবনায় পুর্ণজাগরণ দেখা দিয়েছে। পাটশিল্পের বহুমাত্রিক ও নান্দনিক ব্যবহার দিন দিনই বাড়ছে।

আধুনিক রুচিশীলতার সাথে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাট এবং পাট থেকে তৈরি সুতা দিয়ে শতরঞ্জি, ব্লেজার, জুতা, বাহারি রঙ- বেরঙের ব্যাগ, ঝুড়ি, ওড়না, ঘর সাজানোর নানা সামগ্রীসহ ১৩৫ রকমের বহুমুখী পাটপণ্য তৈরি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিকতার কারণে রুচিশীল ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে পাটপণ্য। এক সময় বাংলাদেশের পাটের বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল ভারত, চীন ও পাকিস্তান। আমরা জানি, অবিভক্ত বাংলায় পাটের বর্ণময়, উজ্জ্বল ও সোনালি অধ্যায় শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। সময়ের পরিবর্তনে বাজার বিস্তৃত হয়েছে থাইল্যান্ড, সুদান, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, নিউজিল্যান্ডসহ আরও ২২টি দেশে।

১৮৯০-এর দশকে পাট সোনালি আঁশের মর্যাদা অর্জন করেছিল। এরপর অবহেলায় অনাদরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ২০১০ ও ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী তোষা ও দেশি পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের ৫ বছরের মাথায় জিন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রবি-১ নামে পাটের একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন মাকসুদুল আলমের অনুসারীরা।

নতুন উদ্ভাবিত রবি-১ জাতের তোষা পাটের জাত থেকে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি ফলন পাওয়া গেছে। বিশ্বে সবচেয়ে সস্তা, পরিবেশবান্ধব ও বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্রাকৃতিক তন্তুর নাম পাট। পাট একটি পরিবেশ বান্ধব ফসল। প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। পাট ফসল পৃথিবীর গ্রিন হাউজ গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।

জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পাট কাঠির ব্যবহৃত হওয়ায় বন উজাড়ের হাত পরিবেশ রক্ষা পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দেয়। পাট ফসলের কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা প্রতি বর্গমিটার জায়গায় ০.২৩ থেকে ০.৪৪ মিলিগ্রাম। পাট ফসল ১০০ দিনে হেক্টর প্রতি বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে।

আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাট ফসল উৎপাদন কালে হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে যোগ হয়। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এছাড়াও পাট ফসল কর্তনের পর পাট গাছের গোড়াসহ শিকড় জমিতে থেকে যায় যা পরবর্তীতে পঁচে মাটির সাথে মিশে জৈব সারে পরিনত হয়। এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে। সহজ হিসেবে যে জমিতে পাট চাষ হয় সে জমিতে অন্য ফসলও ভালো হয়। পাট জাগ দেওয়ার পর ছালের আঁশ ভিন্ন অন্যান্য নরম পচে যাওয়া অংশ, জাগের ও ধোয়ার তলানী এবং পাট পঁচা পানি উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহার যোগ্য। পাট চাষ থেকে পশুখাদ্য ও সবজি পাওয়া যায়।

অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের আর্থিক লাভ অন্যান্য অর্থকরী ফসলের তুলনায় অনেক সম্ভাবনাময়। পাট একটি পরিবেশ বান্ধব ফসল। কার্বন ইস্যুতেও পাট গুরুত্বপূর্ণ ফসল। প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরন করে বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। এক হেক্টর জমির পাট ১৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে, যেখানে ধান শোষণ করে মাত্র পাঁচ টন। পাট ফলস বায়ুমন্ডলে ১১ টন অক্সিজেন মুক্ত করে। এক হেক্টর জমির পাট ১০ টন বায়োমাস মাটিতে যুক্ত করতে পারে, যা মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাট ফসল উৎপাদন কালে হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে যোগ হয়।

পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এছাড়াও পাট ফসল কর্তনের পর পাট গাছের গোড়াসহ শিকড় জমিতে থেকে যায় যা পরবর্তীতে পঁচে মাটির সাথে মিশে জৈব সারে পরিনত হয়। এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে। সহজ হিসেবে যে জমিতে পাট চাষ হয় সে জমিতে অন্য ফসলও ভালো হয়। পাট জাগ দেওয়ার পর ছালের আঁশ ভিন্ন অন্যান্য নরম পচে যাওয়া অংশ, জাগের ও ধোয়ার তলানী এবং পাট পঁচা পানি উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহার যোগ্য।

পাটের ব্যাগ, জুতা, স্যান্ডেল, তৈজসপত্রসহ বৈচিত্র্যময় পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে সারা দেশের ২১ জেলায় পাটশিল্প পল্লী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এসব পাটপল্লীর জন্য চালু ও বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলের খালি জায়গা ব্যবহার করা হতে পারে। অপর এক খবরে জানা যায়, ২০১৯ সালের মধ্যে দেশে পাট থেকে সুতার প্রধান কাঁচামাল ভিসকস উৎপাদন শুরু হবে। দেখতে সুতার মতো কিন্তু সুতার চেয়েও সূক্ষ ভিসকস এক ধরনের রেশম, যা দিয়ে সুতা তৈরি করা যায়। ভিসকস ব্যবহার হয় তুলার বিকল্প হিসেবে সুতা তৈরির কাজে।

বলা হচ্ছে, পাট থেকে ভিসকস বা রেশম তৈরি করা গেলে তা সোনালী আঁশের সম্ভাবনা আাো বহুগুণে বেড়ে যাবে। আরও আশার খবর হচ্ছে- পাট থেকে ডেনিম কাপড় তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রথমে পাট ও তুলার মিশ্রণে সুতা তৈরি করা হবে। সেই সুতা থেকে বানানো হবে ডেনিম কাপড়। উৎপাদিত কাপড় থেকে প্যান্ট, জ্যাকেট, শার্টের মতো পোশাক বানিয়ে রফতানি ও বেসরকারি খাতে কাপড় সরবরাহ করা হবে।

খবর আরো আছে, পাট দিয়ে প্রচলিত পলি ব্যাগের মতোই তৈরি হয়েছে পচনশীল পলিথিন ব্যাগ। বাজারে যে পলিথিন ব্যাগ আছে তার চেয়ে দেড়গুণ বেশি টেকসই এবং ব্যবহার স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যাবে এই পাটের পলিথিনে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি হবে এই ব্যাগ। পাট দিয়ে এখন তৈরি হচ্ছে রকমারি পণ্য। যার ব্যবহারে স্বাছন্দ্য বোধ করছেন সৌখিনরা। পাটের বাহারি পণ্য সম্ভারে এসেছে নান্দনিক ডিজাইন ও পরিবেশবান্ধব রঙের ব্যবহার। পাট দিয়ে ব্যাগ, স্যান্ডেল এমনকি গয়নাও তৈরি করা হচ্ছে। এখন শহুরে আধুনিক মেয়েরা বিয়ে, গায়ে হলুদের সাজে পাটের গয়নায় নিজেদেও সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলছেন প্রাকৃতিক নান্দনিকতায়।

পাটের গয়না তৈরি করেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যার ফলে এখন পাটের হ্যান্ডিক্রাফটস পণ্য ‘পাটের গয়না’ নামে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে। অপরদিকে দেশী পাটের লবণসহিষ্ণু নতুন চার জাতের পাট চাষে শতভাগ সফলতা পাওয়া গেছে। যারফলে কৃষি অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। লবণাক্ত জেলাগুলো- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, কক্সবাজার, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী এবং পিরোজপুরে লবণসহিষ্ণু নতুন চার জাতের পাট চাষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

পাটের নতুন সম্ভাবনা উপলব্ধি করে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি যুগান্তকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন। পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করায় পাট চাষি ও রপ্তানিকারকরা উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করা হয়েছে। সিনথেটিক বস্তা নিষিদ্ধ করে ‘প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ পাস করায় পাটের বস্তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বার্ষিক পাটের বস্তার চাহিদা ১০ কোটি থেকে বেড়ে ৭০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ কাঁচা পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা পাটপণ্য নিয়ে জোরকদমে নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করছে।

এস এম মুকুল : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]  

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer