Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ২ ১৪৩১, মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪

ছাতকের সাড়ে ৩শ’বছরের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের সেকাল একাল

এএফএম ফারুক চান মিয়া

প্রকাশিত: ০৩:০৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

ছাতকের সাড়ে ৩শ’বছরের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের সেকাল একাল

লেখক

ছাতক, সুনামগঞ্জ থেকে: সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা উচু-নীচু পাহাড়, খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড় ও সবুজের সমারোহে সুরমা, চেলা ও ধলাই নদীর মোহনায় কমলালেবু আর চুন ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ছাত্তিরবাজার, ছাতার বাজার ও পরে ছাতকবাজার নামে এখানে একটি ব্যবসা কেন্দ্রের গোড়া পত্তন হয়। ১৭৭৪ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় জর্জ ইংলিশ ব্যবসা করার জন্যে স্ব-পরিবারে এখানে অবস্থান করে চুনা পাথরের ব্যবসার আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। সেই সময়ে ছাতক চুনশিল্পে সারা বিশ্বে পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করে।

১৮১৮ সালে এইচ টি রাইট ও ১৮৫০সালে জর্জ ইংলিশের মৃত্যু হলে তাদের স্মৃতিকে স্মরনীয় করে রাখতে হ্যানরি ইংলিশ ১৮৫০ সালে বাগবাড়িস্থ টিলার সুউচ্চ চুড়ায় ঐতিহাসিক সাহেব মিনার নির্মাণ করেন। যার নির্মাণ শৈলী আজ ও ভ্রমণ বিলাসীসহ সকল মহলের কাছে গৌরবময় ঐতিহ্যে লালিত হয়ে আসছে।

১৮৬৯ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া জেনারেল ষ্টিম নেভিগেশন কোম্পানি গোয়ালন্দ থেকে সিলেট পর্যন্ত জাহাজ চলাচল শুরু করলে ছাতকের ষ্টেশনকে একটি প্রধান জাহাজ ষ্টেশন হিসেবে গন্য করা হতো। পরবর্তীতে জয়েন্ট ষ্টিমার কোম্পানির যৌথ মালিকানা ক্রয় করে (ভূমিসহ) আইজিএনআরএসএন রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেড একক মালিকানা গ্রহণ করে।

পাকিস্তান আমলে কোম্পানিটি পাকিস্তান রিভার্স ষ্টিমার্স কোম্পানি (পিআরএসসি) নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এটি ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন লিমিটেড নাম ধারণ করে। যাতে ১ একর ৮০ শতক ভূমিতে অফিস, বাংলো ও পাথর রাখার সাইড এখনও রয়েছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কমলালেবু ও চুন ব্যবসার সাথে সিঙ্গেল-বোল্ডার ও বালু-পাথরের ব্যবসায় আরো সমৃদ্ধি লাভ করে।

ছাতক-ভোলাগঞ্জ রঞ্জুপথের (রোপওয়ে) ছাতকস্থ আনলোডিং বাংকার

চুনা পাথরের সহজলভ্যতায় ১৯৩৭ সালে ৬০ হাজার মেট্রিকটন উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে সুরমা নদীর উত্তর পারে প্রতিষ্টিত হয় আসাম-বেঙ্গল সিমেন্ট কারখানা। প্রায় ২০ কিলোমিটার রোপলাইনের (রজ্জুপথ) মাধ্যমে ভারতের আসাম রাজ্যের কুমরায় নিজস্ব খনি থেকে চুনা পাথর নিয়ে আসা হয়। যা- ১৯৬৫সালে ছাতক সিমেন্ট কারখানা নামে অভিহিত হয়। এর অভ্যন্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সীমাহীন দূর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাও লুঠপাটের ফলে কারখানাটি এখন ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে এসে ঠেকেছে।

১৯৫২ সালে সিলেট থেকে ছাতকবাজার পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রেল লাইন স্থাপন করা হয়। ১৯৬৬ সালে রেলওয়ের নিজস্ব পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর পরিবহনের লক্ষ্যে ১৯৬৮সালে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ছাতক-ভোলাগঞ্জ রজ্জুপথ নির্মাণ করা হয়।

১৯৭৫ সালের জুন মাসে ১শ’ ৪০একর ভূমির উপর স্থাপিত সিলেট পাল্প এন্ড পেপারমিল উৎপাদন শুরু করে। এখানে পেপার মেশিন স্থাপন না করায় অব্যাহত লোকসানের বোঝায় ২০০২ সালের ৩০নভেম্বর মিলটি পে-অফ ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৭ অক্টোবর রেলওয়ের মালিকানায় ১০ বছর মেয়াদি কাঠের স্লিপারের পরিবর্তে ৫০ বছর মেয়াদি কংক্রিট স্লিপার উৎপাদনে দেশের একমাত্র প্রিস্ট্যাট কংক্রিট স্লিপার প্ল্যান্ট তৈরী করা হয়।

এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭৫হাজার পিস্ হলেও এখন এটি বন্ধ রয়েছে। ১৯৯৩ সালে এখানে আইনপুর সিমেন্ট কারখানা উৎপাদনে যাবার পর মালিকানা বদল হলে প্রাইম সিমেন্ট কারখানা নামে অভিহিত হয়। এটি ও এখন বন্ধ রয়েছে।

১৯৯২ সালে প্রস্তাবিত আকিজ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ১৯৬২সালে প্রস্তাবিত জালালাবাদ সিমেন্ট লিমিটেড এখনও প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। এককালের সহ¯্রাধিক চুন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের (পাজু) মধ্যে এখন রয়েছে সিকিভাগ। বেড়েছে স্টোন ক্রাশার মেশিনসহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। তবে প্রস্তাবিত আকিজ সিমেন্ট কারখানার একাংশে এখন আকিজ বেভারেজ ফুড লিমিটেড নামে একটি কারখানা স্থাপন করলেও তাদের প্রতিশ্রুত সিমেন্ট কারখানা স্থাপন করেনি। এ ছাড়া সিলেট পাল্প এন্ড পেপারমিল পানির দরে বিক্রির পর নিটল-নিলয় গ্রুপ এখানে কার্টিজ পেপার উৎপাদন করলেও পূর্নাঙ্গ পেপারমিল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়নি।

ছাতকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়াত্ব সিমেন্ট কারখানা 

এদিকে দু’পাড়ের মানুষের মধ্যে সান্নিধ্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের ২৩ আগষ্ট সুরমা নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্বোধন করলে গত ১০ বছর থেকে বন্ধ রয়েছে। ১৯৮৪ সালে ছাতক থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। এসময় প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণে ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে ছাতক ও ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলা গঠিত হয়।

ছাতক থেকে ইসলামপুরসহ কয়েকটি ইউনিয়ন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত হয়। উপজেলা গঠনের পর প্রথম নির্বাচনে সুজন মিয়া চৌধুরী, ১৯৯১ সালে মুহিবুর রহমান মানিক, ২০০৯ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরী মিজান ও ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অলিউর রহমান চৌধুরী বকুল ছাতক উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৯৭ সালে ছাতক পৌরসভায় উন্নীত হলে ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনে প্রথম পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আব্দুল ওয়াহিদ মজনু। পরের ৩টি নির্বাচনে আবুল কালাম চৌধুরী মেয়র পদে বিজয়ী হয়ে হ্যাট্রিক করেন। ৪শ’ ৩৪ বর্গ মাইলের এ উপজেলায় গ্রামের সংখ্যা রয়েছে ৫শ’ ১২টি। তবে শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে উপজেলাবাসী দীর্ঘদিন থেকে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন।

এখানে সরকারি ১শ’ ২২টি, রেজিষ্ট্রার্ড (বর্তমানে সরকারি) ২৯টি ও কমিউনিটি ১১টিসহ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে দেড় শতাধিক। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সাড়ে ৩শ’ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। ৩ লক্ষাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ উপজেলায় চন্দ্রনাথ গার্লস হাইস্কুল ছাড়া মেয়েদের শিক্ষার স্বতন্ত্র কোন হাইস্কুল ও কলেজ নেই। এখানে ৩৫টি নিন্ম মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২০টি মাদরাসা বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল।

২টি অনার্স ডিগ্রী কলেজসহ ৪টির কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের সংকুলান হয়না। এখানে ৪টি ভূমি অফিস, ১টি ফায়ার সার্ভিস, ১টি কারিগরী স্কুল ও কলেজ রয়েছে। এ উপজেলায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ৫০ শয্যার ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৩০শয্যার ১টি পল্লী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারদের দায়িত্ব পালনকালে রোগীরদের কাছ থেকে ফি আদায়, সীমাহীন দূর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক ও নার্স সংকটে চিকিৎসা সেবা মারত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

এছাড়া ৫টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১২টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৬টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের দরজায় তালা ঝুলে প্রায় মাসের পর মাস। ইসলামপুর ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ভারতের সীমান্তবর্তী ছনবাড়ি বাজারে স্থাপন করা হলেও মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় এটি এক যূগ থেকে বন্ধ রয়েছে। একইভাবে ডাক্তার না থাকায় দরজায় তালা ঝুলছে ছৈলা-আফজালাবাদ ইউনিয়নের বাংলাবাজারস্থ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের খুরমা ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ফলে সরকারি চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিপুল সংখ্যক রোগি। একটি মাত্র উপজেলা প্রাণী সম্পদ হাসপাতালে তীব্র কর্মচারি সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।

এ উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় সর্বত্র নাজুক দশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখানে প্রায় ২শ’ কিলোমিটার পাকা ও প্রায় সাড় ৩শ’ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা, দেড় শতাধিক কালভার্ট, প্রায় ১শ’ ৪০টি ব্রিজ, ১৪কিলোমিটার রেল পথ, ৬২কিলোমিটার নদীপথ ও ১২টি বড় খাল রয়েছে। তবে কাঁচা ও পাকা রাস্তার সিংহভাগই এখন সংস্কারের অভাবে চলাচলের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। এখানে প্রায় ৮৫হাজার পরিবার, ২হাজার ৮শ’জন আধিবাসী ও মোট জমি রয়েছে ১লাখ ৮হাজার ৮শ’৩৪ একর।

এদিকে ছাতকের সুস্বাদু কমলালেবু এখন আর চোখে পড়েনা। অসম প্রতিযোগিতায় বিলুপ্ত হতে চলেছে একসময়ের জমজমাট চুন শিল্প। পাহাড়ি চেলা নদী এখন মরা চেলা নাম ধারণ করেছে। পাহাড়ি ঢলের সাথে বালু আসায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে চেলা ও ধলাই নদী। রক্ষণাবেক্ষণ ও সরকারি পৃষ্টপোষকতার অভাবে বন্ধ হতে চলেছে নদী পথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।

ছাতকে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা 

ধলাই নদী নাব্যতা হারানোয় ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী থেকে পাথর পরিবহন ও চেলা নদী ভরাট হওয়ায় ভারত থেকে চুনা পাথর আমদানি বন্ধ হবার আশংকা রয়েছে। ফলে এরসাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১০ সহস্রাধিক পাথর শ্রমিক বেকার হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

এভাবে সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে শত শত ক্রাশার মেশিন ও অবৈধ ওয়াশিং মেশিনের ডাষ্টে। ফলে হেমন্তকালে সুরমা নদীর বিভিন্ন অংশে চর জেগে উঠায় বার্জ, কার্গো, বাল্কহেড ও পন্যবাহী নৌকা চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যা ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা কাঠিয়ে ক্রমশঃ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে এখানের ব্যবসা-বাণিজ্য। বাড়ছে জীবন যাত্রার মানও।

এছাড়া এখানের চুন শিল্পের বিকাশে নারায়নগঞ্জে তিতাস গ্যাসের চুরি বন্ধ, সুরমা নদী ড্রেজিং ও নদী শাসন, ছাতক সিমেন্ট কারখানা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রেল বিভাগও ভূমি অফিসের দূর্নীতি বন্ধ, ইতিহাস ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, উপজেলা ও পৌরসভার যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নসহ সর্বক্ষেত্রে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার সরকারের কাছে দাবি এলাকার সচেতন মহলের।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer