ঢাকা : চীনে ন্যায় বিচারপ্রার্থী এক মহিলার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে চরম বিপদে পড়েছিলেন বিবিসির জন সাডওয়ার্থ। সরকারী সমর্থনপুষ্ট গুন্ডারা তাঁর ওপর হামলা চালায়, ভেঙ্গে ফেলে ক্যামেরা।
ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয়। জন সাডওয়ার্থের কাছেই শুনুন সেই কাহিনি: আমাদের পরিকল্পনাটা ছিল খুব সোজা-সাপ্টা। চীনের মধ্যাঞ্চলের হুনান প্রদেশের একটি গ্রামে আমরা এক মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। এরপর আমরা ট্রেনে করে বেইজিং যাব। যাওয়ার পথে আমরা ভিডিও করবো। কিন্তু যে মহিলার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য এই পরিকল্পনা, তার সঙ্গেই আমরা দেখা করতে পারলাম না।
চীনে ক্ষমতার দাপট কিভাবে চলে, সেটা হয়তো কোন সাক্ষাৎকারেই তুলে আনা যেত না যেভাবে তা ফুটে উঠেছিল আমাদের এই কাহিনির সমাপ্তি পর্বে।
সহিংসতা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়--সব কিছুই ছিল এর মধ্যে। চীনে একজন রিপোর্টার হিসেবে আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমন ঘটনার মুখোমুখি এবারই প্রথম। `বেআইনি সাক্ষাৎকার` গ্রহণ এবং আমার আচরণের মাধ্যমে `বাজে প্রভাব ফেলার` জন্য আমাকে ক্ষমাও চাইতে হলো।
আমরা যার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলাম তাঁর নাম ইয়াং লিংগুয়া। তাঁর মতো যারা কোন অন্যায়ের বিচার চেয়ে বেইজিং এ গিয়ে ধর্ণা দেন, তাদেরকে চীনে বলা হয় `পিটিশনার` বা আবেদনকারি।
প্রতি বছর হাজার হাজার চীনা নাগরিক যখন স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত আদালতের কাছে নালিশ করে সুবিচার পান না, তখন তারা রাজধানীতে যান তাদের অভিযোগ জানাতে। যেখানে তারা অভিযোগ দায়ের করেন তার নাম `স্টেট ব্যুরো অব লেটার্স এন্ড কলস।`
দুর্নীতি, জমি দখল, স্থানীয় কর্মকর্তাদের অনিয়ম, স্বাস্থ্য সেবায় গাফিলতি, পুলিশের নিষ্ঠুরতা--এরকম বহু বিষয়ে তারা অভিযোগ নিয়ে আসেন।
পুরো ব্যবস্থাটাই চালায় কমিউনিস্ট পার্টি, কাজেই নালিশ করে প্রতিকারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু অনেকের জন্য এটাই একমাত্র প্রতিকারের পথ। কাজেই তারপরও তারা এখানে আসেন।
ইয়াং লিংহুয়ার পরিবারও এভাবেই ন্যায় বিচার পেতে চেয়েছিল।
তিন বছর আগে বিবিসি তাঁর বোন ইয়াং কিংহুয়ার সাক্ষাৎকার নেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, তাদের কাছ থেকে তাদের জমি কেড়ে নেয়া হয় এবং তাদের বাবাকে এই বিবাদের সময় মারাত্মকভাবে পেটানো হয়। এতে তিনি মারা যান।
এই সপ্তাহেই চীনের রাজধানী বেইজিং এ শুরু হবে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলন। তার আগে তারা বেইজিং যেতে চেয়েছিলেন এ নিয়ে অভিযোগ দায়ের করার জন্য। এই সম্মেলনের আগে বহু মানুষই তাদের অভিযোগ নিয়ে বেইজিং যান।
বেইজিং এর কর্তৃপক্ষ এদেরকে সম্মেলন কেন্দ্র থেকে দূরে রাখতে চান। এজন্যে সারাদেশে প্রাদেশিক পর্যায়ের কর্মকর্তারা চেষ্টা করেন কিভাবে এরকম লোকজনের বেইজিং যাওয়া ঠেকানো যায়।
আমরা জানতাম যে মিস ইয়াং এর মা এবং বোনকে ইতোমধ্যে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে।
কিন্তু মিস ইয়াং ভেবেছিলেন, তিনি ট্রেনে চেপে আমাদের সঙ্গে বেইজিং চলে যেতে পারবেন এবং তাকে কর্তৃপক্ষ অতটা সন্দেহ করবে না। কিন্তু তার ধারণা ছিল ভুল। আমরা যখনই ইয়াং লিংহুয়ার গ্রামে হাজির হলাম, এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে তারা সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
তার বাড়ির সামনের রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়িয়ে ছিল একদল লোক। কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা আমাদের ওপর হামলা করলো, এবং আমাদের ক্যামেরাগুলো ভেঙ্গে ফেললো।
চীনে বিদেশি সাংবাদিকদের এরকম ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয়। কিন্তু এরপর যা ঘটলো তা ছিল খুব অস্বাভাবিক। আমরা যখন গ্রাম থেকে বেরিয়ে এলাম তখন প্রায় বিশ জনের একটি গুন্ডা দল আমাদের তাড়া করলো এবং আমাদের গাড়ি ঘিরে ধরলো।
পরে এদের সঙ্গে যোগ দিল কিছু ইউনিফর্মধারী পুলিশ। এদের হুমকির মুখে আমাদেরকে রেকর্ড করা অনেক ফুটেজ নষ্ট করে ফেলতে হলো। আমাদেরকে লিখিতভাবে `দোষ স্বীকার` করতে বাধ্য করা হলো।
পুরো ব্যাপারটা ছিল একেবারে একতরফা। তবে আমরা একদিক দিয়ে ভাগ্যবান যে আমরা ছাড়া পেয়েছি। স্থানীয় যারা নালিশ করতে যায়, তাদের এই সৌভাগ্য হয় না।
ইয়াং লিংহুয়ার বোন আমাদের কাছে যে ভিডিও পাঠিয়েছিল তাতে দেখা যাচ্ছে, যারা আমাদের হুমকি দিয়েছিল সেই একই দলটি তাঁকে আটকে রেখেছে। এই রিপোর্টের জন্য যখন আমরা তথ্য সংগ্রহ করছিলাম, তখন এক মহিলার সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তার বয়স এখন ৭০ এর বেশি।
১৯৮৮ সাল থেকে এই মহিলা একটা অভিযোগ করে যাচ্ছেন। তার স্বামীর হত্যাকারীদের যেন আরও দীর্ঘমেয়াদের সাজা দেয়া হয় সেটাই তাঁর আবেদন। কিন্তু এই মহিলা আমাদের জানিয়েছেন ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের সময় প্রতি বছর দশদিনের জন্য তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। যাতে তিনি বেইজিং যেতে না পারেন।
আরেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয় যিনি তার ছেলের অপহরণের ব্যাপারে অভিযোগ করতে চান। তাকে সতর্ক করে দেয়া হয় তিনি যেন সপ্তাহে বেইজিং যাওয়ার চেষ্টা না করেন।
ইয়াং লিংহুয়া এবং তাঁর পরিবার হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর আমরা এখনো পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে আর কোন খবর পাইনি। বেইজিং এর সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমরা এই পরিবারটির নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস চেয়েছি।
বেইজিং এ যখন ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের অধিবেশনের প্রস্তুতি চলছে, তখন দেশটির আরও বহু মানুষ যে এরকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আর আমার কাছ থেকে জোর করে ক্ষমা প্রার্থনার চিঠিতে স্বাক্ষর নেয়ার পরও আমি বলতে চাই, চীনের এরকম মানুষদের সাক্ষাৎকার নেয়ার চেষ্টা করার জন্য আমি মোটেই অনুতপ্ত নই। বিবিসি বাংলা