Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১০ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

চাকরির প্রলোভনে নেওয়া মুক্তিযুদ্ধের সনদ ফেরত চান মাজেদ মন্ডল

তুহিন আহামেদ, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:৩৫, ৮ জুন ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

চাকরির প্রলোভনে নেওয়া মুক্তিযুদ্ধের সনদ ফেরত চান মাজেদ মন্ডল

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

গাজীপুর-সাভার ব্যুরো : ‘আমার সাহেব খুব ভাল লোক, তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা, তার সাথে ভাইকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দিব। ওর কুষ্টিয়া যাওয়ার দরকার নেই। একটা কাজ করেন ওর মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট, স্কুল সার্টিফিকেট, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট এবং তিন কপি ছবি দাও। আমি এগুলো নিয়ে দিব। সাহেব ওনার ছেলের সাথে মাজেদকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দিব।’

-এই বলে মাজেদ মন্ডলের মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্র, স্কুল সনদপত্র, চেয়ারম্যান সনদ এবং তিন কপি ফটো নিয়ে যায় মাজেদ এ দূর সম্পর্কের চাচা মালেক মন্ডল। ৮নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করা মাজেদ মন্ডল এখন অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। তবে বছরের পর বছর ধরে মালেক মন্ডলকে খুঁজে বেড়ায় মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ মন্ডল।

কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ মন্ডলের সাথে। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি জানান, তার নাম মো. মাজেদ মন্ডল। বয়স ৬৫ কি ৬৬ বছর। পিতা মৃত. শাহাদাত মন্ডল। বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আমলাপাড়া এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ৮নং সেক্টরে কমান্ডর মেজর আবু উসমান চৌধুরী এবং এম এ মঞ্জুর এর অধীনে। বর্তমানে গাজীপুর মহানগরীর ১নং ওয়ার্ডের উত্তর পানিশাইল হাজীর টেক এলাকার মেয়ের জামাই শাহ জামাল এর বাড়ীতে থাকেন। তিন মেয়ে কোন ছেলে সন্তান নেই। মেয়ে দুটি পোশাক কারখানায় চাকুরি করেন এবং ছোট মেয়ে ইন্টারে পড়াশোনা করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় যখন জানতে পারেন, ঢাকায় অনেক জওয়ানদের পাকবাহিনীরা হত্যা করছে, তখন গ্রামের অধিকাংশ লোকজন পালিয়ে যাচ্ছিল দেশের বাহিরে কিংবা অন্যত্র। ঠিক সেই সময় মাজেদ মন্ডল ও এলাকার আরো ১৭ জন মিলে মুক্তিযোদ্ধের প্রশিক্ষণনেওয়ার জন্য ভারতে রওনা দেন। তবে ভারতে দুইদিন পর পৌছান। ভারতে গিয়ে প্রথমে বেতায় যান। সেখানে কোন সিট না থাকায়, সেখান থেকে তাদেরকে করিমপুর পাঠিয়ে দেয়া হয়। করিমপুরে কোন সিট না থাকায় সেখান থেকে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় বনগ্রাম। বনগ্রামে তাদের ভর্তি করে নেন এবং তাদের একটি করে প্লেট, একটা মগ এবং একটি মশারি দিয়ে ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দিলেন।

তিনি জানান, ‘সেখানে ১২ দিন অবস্থান করার পর শেখ সাহেবের ভাগিনা সহ আরো তিন/চারজন রাতে এসে আমাদের বলল, আগামীকাল সকালে আপনারা পিটিতে দাঁড়াবেন। এখান থেকে বেছে কিছুলোককে হায়ার ট্রেনিং করানোর জন্য দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হবে। বাছাইয়ে ৬৫জন টিকলাম। আমার দলে ১৭ জন ছিলাম। ১৭জনে থেকে আব্দুল মাজেদ মামুন এবং বাশার আমরা তিনজন চান্স পেলাম হায়ার ট্রেনিং এর জন্য।

বাছাইয়ের পরে সেখান থেকে আমাদের নিয়ে রওনা হলেন। বনগ্রাম ষ্টেশন থেকে শিলাইদহ, সেখান থেকে ট্রেন যোগে নিয়ে গেল রাত ১১টার দিকে হাওড়া। সেখানে ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর জানা গেলে যে ফিল্ডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। সেখানে যাওয়া হবে না। পরে আমাদের প্রত্যেকের হাতে ১০ টাকা করে দিয়ে পুনরায় ক্যাম্পে ফিরে আসতে বললেন। পরে আমরা ক্যাম্পে ফিরে আসি।’’

মাজেদ মন্ডল বলেন, ‘‘ক্যাম্প ১০/১২দিন থাকার পর বিহারে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি ট্রাক আসে। তবে ট্রাকযোগে বিহারে না নিয়ে হাসনাবাদ চৌকি ক্যাম্পে নিয়ে গেল। সেখানে কিছুদিন থাকার পর কুষ্টিয়ায় আমার এক ভগ্নিপতি কমান্ডার মেজর আবু উসমান চৌধুরী এবং এমএ মঞ্জুর এর নিকট নিয়ে গেল। সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপারেশন করেছি এবং প্রচুর পরিমাণে গোলা বারুদ উদ্ধার করেছি।’’

এরপর দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীন এর পর আমার সাথে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের চৌরস এতিমখানার একটি বেরাখে রাখা হয়। আমার সাথে কুষ্টিয়ার কুমোড়পাড়ার মো. নাসির মল্লিক, ফরিদপুরের মো. ফজলু বিশ্বাস, কুষ্টিয়ার তোফাজ্জল হোসেন এবং আমিরুল ইসলাম সহ আরো অনেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ছিলেন। এদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি।’’

মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ মন্ডল জানান, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার তিন মাসে তিনশত টাকা ভাতা দিত। এর পর আমাদের কে কোন পদে চাকুরি করবে এরকম একটি ফরম ফিলাপ করতে বলে। আমি বর্ডার কাস্টম পদে ফরম ফিলাপ করি। পরে অস্ত্র জমা নিয়ে একটি সার্টিফিকেট দেয়। পরে ৬দিনের জন্য সকলকে বাড়িতে চলে যেতে বলে। ৬দিন পর এসে যে যার পদে চাকরিতে যোগদান করবে। তাদের কথামত আমি ছয়দিনে জন্য বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে তিন দিন অবস্থান করার পর আমার বাবার খালাতো ভাই মালেক মন্ডল আমাদের বাড়িতে আসেন। এরপর আমার বাবা ও মাকে নানা ছলচাতুরী দিয়ে আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকুরি দেয়ার কথা বলে আমার মুক্তিযুদ্ধের সনদ, তৎকালীন চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, স্কুল সার্টিফিকেট এবং তিন কপি ছবি নিয়ে আসে। এরপর আমাদের সাথে সে আর কোন যোগাযোগ করেনি।’

তিনি আরো জানান, ‘লোকমুখে শুনছি সে (মালেক মন্ডল) ঢাকায় এসে আমার সার্টিফিকেট দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এখন নাকি বসুন্ধরার ১১ নম্বর এ থাকেন। তার এক ছেলে সুপ্রিম কোর্টের এ্যাডভোকেট। নাম মাহামুদুল হাসান।’

মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ মন্ডল কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, আমার মুক্তিযুদ্ধের সনদ নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওই মালেক মন্ডল। যে কিনা মুক্তিযুদ্ধ না করেও এখন মুক্তিযোদ্ধা। আর আমি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও সমাজে কোন মুক্তিযোদ্ধার মূল্যায়ন পায়নি। আমার মেয়েরা আজ পোশাক কারখানায় চাকরি করে সংসার চালায়।ে সই সংসারে আমি বুঝা হয়ে আছি। আমি শুধু আমার মুক্তিযোদ্ধার সনদ ফেরত চাই এবং আমার ও আমার বাবা-মায়ের সাথে প্রতারণা করে আমার মুক্তিযোদ্ধের সনদ নিয়েছে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানাই।’

আজও খুঁজে বেড়ায় যুদ্ধের পর তার সার্টিফিকেট নিয়ে আসা মালেক মন্ডলকে। পাবে কি খুঁজে তাকে ? এদিকে, অভিযুক্ত মালেক মন্ডল, পিতা ইয়ার উদ্দিন, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার। বর্তমানে ঢাকার বসুন্ধরা ১১ নম্বর বাড়িতে বসবাস করে বলে জানা যায়। তার এক ছেলে মাহামুদল হাসান ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজিবী। তবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ মন্ডলের বড় মেয়ে রাফিজা বেগম জানায়, আমার বাবা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শুধু তাই নয় আমরাও এ থেকে বঞ্চিত। যে আমার বাবার মুক্তিযোদ্ধের সনদ নিয়ে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত তাকে খুঁজে বের করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় যেন তার শাস্তির ব্যবস্থা করেন এবং আমার বাবা যেন মুক্তিয্দ্ধুার স্বীকৃতি পায় সে দাবী জানাই।

মাজেদ মন্ডলের সাথে মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ করা ফরিদপুরের মো. ফজলু বিশ্বাস এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘মাজেদ, আমি , নাসির, তোফাজ্জল ও আমিরুল সহ আরো অনেকে এক সাথে যুদ্ধ করি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ৬দিন পর আমারও সেখানেযোগদান করার কথা ছিল। কিন্তু বাড়িতে আসার পথে আমার সাথে থাকা কাগজপত্র সবকিছু হারিয়ে ফেলি। তবে এটা সত্য যে মাজেদ সহ আমরা অনেকেই এক সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি।’

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer