Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

গ্লানি মোচনের পথে যেতে হবে বহুদূর

আশরাফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০২:০১, ৭ মার্চ ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

গ্লানি মোচনের পথে যেতে হবে বহুদূর

গত ২৩ জানুয়ারি (২০১৮) ঢাকায় নেতাজির জন্মোৎসবে শোভাযাত্রা । ছবি : বহুমাত্রিক.কম

ঢাকা : এ বছর (২০১৮) ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে উদযাপিত হল ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২১তম জন্মবার্ষিকী। এ দিনটিতে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে পর পর বেজে উঠেছিল ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি’ ও ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে’।

বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে গীত হওয়ার নজিরও বোধহয় এই প্রথম। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের ওই আবেগঘন মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, এমপি, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ বিশিষ্ট অতিথিরা যেন বড়ই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন।

হাজার বছর ধরে লালিত যে সংস্কৃতি ও জীবনাচার-জীবনবোধে বেড়ে উঠেছেন অখণ্ড ভারতের মানুষ, তার অনেক কিছুই যে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে উদ্যত, সেই অনুভূতিই হয়ত ফুটে উঠছিল জাতীয় জাদুঘরের ওই মিলনায়তনটিতে। অনুষ্ঠানটিতে কেবল ভারতের সরকারি প্রতিনিধিই নন, যোগ দেন কলকাতার আলিপুর বার্তার সম্পাদক ও বিশিষ্ট নেতাজি গবেষক ড. জয়ন্ত চৌধুরিও। নেতাজির জন্মোৎসবের ওই অনুষ্ঠান স্মৃতিকাতরতা ও আবেগাশ্রুতে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

বর্বর ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজ ভারতবর্ষকে দু’শো বছর শোষণ করে যখন আর পেরে উঠছিল না তখন তারা দুরভিসন্ধি আঁটেন-কিভাবে এই জাতির অন্তর্নিহিত শক্তিকে নিঃশেষ করে দেওয়া যায়। তাই তারা অখণ্ড ভারতকে টুকরো করে সেই অভিলাষ চরিতার্থ করে। ব্রিটিশরা সেই দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা পান এদেশিয় কিছু কপট রাজনীতিকদের। তবে ‘মীরজাফর’ সেইসব রাজনীতিকরা জীবদ্দশাতেই যেমন নিদারুণ পরিণতি ভোগ করে গেছেন, তেমনি সমকালেও তারা চরম ধিকৃত।

মাতৃভূমিকে পূর্ণ স্বাধীন করতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনমরণ লড়াইয়ের গৌরবদীপ্ত অধ্যায়কে পাশ কাটিয়ে নিজেদের ‘মহান’ করবার চেষ্টায় ব্যর্থ সেইসব কপটদের ভয়ঙ্কর জিঘাংসা এই ভারতভাগ। জাতির হৃদয়ে যে গভীর ক্ষত ও সর্বনাশ তারা করে গেছেন, বাংলাদেশে নেতাজির জন্মোৎসবে যোগ দিয়ে বহুকাল পরেও ঢুঁকরে কেঁদে উঠেছিল দুই বাংলার জনগণ।

‘খুব আবেগ ছুঁয়ে যাচ্ছে আজকে। আমার পূর্বপূরুষরা ফরিদপুরে ছিলেন, আমার কাকাও একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সম্মাননা নিয়ে গেছেন’

-আপ্লুতকণ্ঠে বলছিলেন নেতাজি গবেষক ড. জয়ন্ত চৌধুরি। নেতাজির জন্মোৎসবে যোগ দিতে কী অপরিসীম আবেগ নিয়ে স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে তিনি বাংলাদেশে আসেন! মাত্র তিন-চারটে দিন তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করেন।

এই সময়ের মধ্যে ড. চৌধুরি পরম ভক্তি নিয়ে ছুটে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধে, গেছেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে। ঘুরে গেছেন নজরুল স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া ব্যাপারির বাড়ি, যা নজরুল জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। কী আবেগ, কী শ্রদ্ধা!

ভৌগলিক সীমানা, কাটাতারের বেড়া কিংবা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের ঝক্কি-সব কিছুই যেন এখানে তুচ্ছ। ভৌগলিক সীমানা হয়ত আলাদা, শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু অন্তরের যে টান, শেকড়ের প্রতি যে দুর্দমনীয় আকর্ষণ তা কী রোধ করা এতই সহজ?

আমরা যদি সাত দশক পেছনে ফিরে তাকাই, ব্রিটিশের বর্বরতা আর শোষণে নাভিশ্বাসস ভারতবর্ষজুড়ে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বাধীনতার জন্য যে সর্বাত্মক সংগ্রামের সূচনা করেন, তাঁর আহ্বান ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’-এতে সাড়া দেন গোটা ভারতবর্ষের আপামর জনগণ। কেবল তরুণ-যুবকরাই নন, নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজে শামিল হন অন্তঃপুরের নারীরাও।

আজাদ হিন্দ ফৌজের সেই স্বাধীনতার যুদ্ধ কেবল ভারতবর্ষের একটি বা দু’টি প্রদেশকে মুক্ত করার যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল গোটা অখণ্ড ভারতেই পূর্ণ স্বাধীন করার সংগ্রাম-ব্রিটিশদের বিতাড়নের শেষ চ্যালেঞ্জ। এখানে উল্লেখ্য, বিপ্লবের মাটি বাংলা থেকেই ব্রিটিশ বিতাড়নের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা হয়েছে। যদিও তা ইতিহাসে ঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বহু তরুণ আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়ে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে নিজেদের উৎসর্গ করেন। চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, যশোরসহ বহু জেলাতেই আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সেনানিদের পরিবার-পরিজনের খোঁজ মিলছে। তাদের বিষয়ে জানবার এতখানি আগ্রহ গত সাত দশকে কেউ দেখাননি, সেই বীরযোদ্ধাদের প্রতি কারও নূন্যতম শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নজিরও দেখা যায়নি।

বিশ্বজুড়ে তাঁর দেশপ্রেমের তুলনা কেবল তিনিই, হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব যাঁর-সেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এখানকার রাজনৈতিক বা বৃদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। যাঁর আহ্বান বিদ্যুতগতিতে এই বাংলার তরুণদের ব্রিটিশ বিতাড়নের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা যুগিয়েছে, তিনি কিভাবে এত দ্রুত বিস্মৃত হয়ে যান এই ভূমি থেকে! এর কারণ খুবই স্পষ্ট। তখনকার কপট রাজনীতিবিদদের বিরামহীন অপপ্রচার ও কলঙ্কিত দেশভাগ নেতাজিকে ভুলিয়ে দিতে মূখ্য ভূমিকা রাখে।

ঢাকায় নেতাজির জন্মোৎসবের প্রধান অতিথি হয়ে আসা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ও বর্ষিয়ান রাজনীতিক আমির হোসেন আমু সেদিন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন, অধিকার সচেতনতায় বাঙালি জাতির বহুকালের এগিয়ে থাকার ইতিহাস।

তিনি বলছিলেন, অধিকার সচেতন বাঙালির তিন নেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’র কথা। তাদের প্রথম দু’জনকেই দল ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল মূলতঃ বাঙালির নেতৃত্বকে দমিয়ে রাখবার জন্যই। আর বাঙালির নেতৃত্ব দমিয়ে রাখা গেলে ব্রিটিশ বা ঔপনিবেশিক শক্তি আরও বহুকাল নির্বিবাদে রাজত্ব করার সুযোগ পেত। আমির হোসেন আমু একে বর্ণনা করেছে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে। বর্ষিয়ান এই রাজনীতিক মনে করেন, ভারত ভাগ মূলতঃ বাঙালি জাতির চেতনা ও আদর্শের যে ঐশ্বর্য, এর প্রতি প্রবল ঈর্ষার নিকৃষ্টতম বহিঃপ্রকাশ। 

বর্তমান প্রজন্ম রীতিমতো ভুলতে চলা ইতিহাসের এই অধ্যায়ের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। তারপরও দেশভাগের যে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব তা সবার অলক্ষ্যে আমাদের পশ্চাতে টেনে নিচ্ছে। দেশভাগের ক্ষত সত্তরোর্ধ্ব বা অশীতিপর বাঙালিদের কাছে কী দুঃসহ, তা কেবল তারাই জানেন। তা সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সঞ্জীবনীশক্তির বলে সকল সেক্টরে বিশ্বে সরব প্রতিনিধিত্ব করছে।

অসাম্প্রদায়িক ও মূল্যবোধ সঞ্চারিত একটি জাতি রাষ্ট্রের যে স্বাতন্ত্র্য-অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তা বজায় রাখতে অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অপরদিকে, পৃথক মানচিত্র, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত কিংবা আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থা, কাটাতারের বেড়া, ইমিগ্রেশনের ঝক্কি পেরিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের যে নাড়ির বন্ধন তা আজও অটুট।

প্রথমবারের মত পূর্বপুরুষদের মাটিতে পা রেখে অশ্রুসজল ড. জয়ন্ত চৌধুরির আবেগতাড়িত উচ্চারণ বাঙালির শেকড়ের প্রতি অপার মমত্বের প্রতিচ্ছবি। ভারতে ফিরে যাওয়ার আগ মুহুর্তে ড. চৌধুরি ব্যাকুল হৃদয়ে বলছিলেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি সুভাষ, কাজী নজরুল বা সাঁইজি লালন যেখানে আমাদের-যেখানে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি এক, যেখানে আমরা মিলবই।’

লেখক : প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম-বাংলাদেশ ও নেতাজি গবেষক।

[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer