Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৪ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

কোটা সংস্কার নিয়ে একটি পর্যালোচনা ও প্রস্তাব

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ২২ এপ্রিল ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

কোটা সংস্কার নিয়ে একটি পর্যালোচনা ও প্রস্তাব

ফাইল ছবি

সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি কিংবা ভর্তি সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা প্রথা নতুন কিছু নয়। শুধু বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও পিছিয়ে থাকা এবং বিশেষ জনগোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে চাকুরি কিংবা ভর্তিতে কোটার মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নজির রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া এমনকি কানাডাতেও এসব কোট প্রথা বিদ্যমান রয়েছে। আর আমাদের বাংলাদেশেও কোটা ব্যবস্থা নতুন কোন বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা প্রথা চালু রয়েছে। তবে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সময়ে সময়ে কোন কোন জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বেড়েছে বই কমেনি।

যেমন ধরা যাক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটার বিষয়টি। বলা হয়ে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের এবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কারণ তাঁরা তাঁদের নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য এবং দেশের সকল শ্রেণির মানুষের কল্যাণার্থে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁদের অনেকে হয়েছেন শহীদ কিংবা বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব, কেউবা আপনজনদের হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সরকার তাঁদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকারি চাকুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রথা চালু করেছিলেন। যদিও বলা হয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস শুধু মুষ্টিমেয় কতক স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাদে পুরো বঙালি জাতিই একসাথে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু সেটা একটা গদবাধা কথা হলেও বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। কারণ যাঁরা সরাসরি রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাঁদের সাথে পরোক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তুলনা হয় না।

আর সেজন্য সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রথা চালু রাখা হয়। আস্তে আস্তে তা আরো প্রাতিষ্ঠানিকতা পেতে থাকে। দেশের গর্বিত সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেশে গঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, কোটা ছাড়াও সৃষ্টি হয় তাঁদের জন্য এবং তাঁদের পরিবারের জন্য বিভিন্নরকম সুযোগ-সুবিধা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সর্বনিন্ম বয়স নির্ধারণ করা হয় ১১বছর। সেভাবে এক পর্যায়ে বয়সের কারণে যখন বিভিন্ন চাকুরিতে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী কমে আসছিল তখনই সদাশয় শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার কর্তৃক সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্যও সেই কোটার আওতায় আনা হয়। এভাবে আরো সময় যেতে যেতে এখন সন্তান সন্তুতি ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করে দেওয়া হয়। বর্তমানে সে কোটা ৩০%।

অপরদিকে জেলা কোটা ১০%, নারী কোটা ১০% ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫% এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১% ধরে দেশে এখন সরকারি চাকুরিতে অনুপ্রবেশের জন্য কোটার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সর্বসাকুল্যে ৫৬%। প্রত্যেকটি কোটাই এতদিন ধরে চলে আসছিল। তবে চাকুরিতে ইন্টারভিউয়ের সকল কোর্স সমাপান্তে সংশ্লিষ্ট কোটার প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা সবসময়ই মেধা তালিকা থেকে পূরণ হয়ে আসছে। কোটার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কিছু আসন খালী থাকলেও এখন আর তা খালী থাকে না। বরং তা মেধাবীদের দ্বারাই পূরণ হয়ে আসারই রেওয়াজ চালু রয়েছে যা সবারই জানা আছে।

অনেকদিন যাবৎ থেকে থেকে এসব কোটা পদ্ধতি সংস্কার নিয়ে কিছুটা প্রতিবাদ হলেও সম্প্রতি হঠাৎই এসব কোটার সংস্কার নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। কথা উঠে সব কোটা বাতিলের। অথচ সংশ্লিষ্ট সকলে এতদিন এই কোটার সুবিধা ভোগ করে আসছে। তবে একথা ঠিক যে কোন জিনিসই সর্বকালের জন্য স্বতঃসিদ্ধ নয়। তা প্রয়োজনে বারংবার পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন করে সংশোধন কিংবা সংস্কার হতেই পারে।

কোটা প্রথাও এমন একটি বিষয় যা সময়ের প্রয়োজনে সংস্কার হওয়ার দাবি রাখে। তা দিনে দিনে হয়েছেও আগে। এবারো হতে পারে। কিন্তু কী পদ্ধতিতে হবে তার জন্য দীর্ঘদিন চলে আসা একটি বিষয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য সময় প্রয়োজন। সরকার একমাসের সময় নিলেন। আন্দোলনকারীরা সহজ সরলভাবে সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করে সময় দিলেনও। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার অদৃশ্য কারণে এবং অদৃশ্য হাতের ইশারায় সেই দেওয়া সময়ের কথা না রেখে আবারো অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন শুরু করে দিল। সেইসাথে কোটার সাথে কোন সম্পর্ক না থাকা সত্তে¡ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন নজিরবিহীনভাবে তছনছ করা হয়েছে।

এরইমধ্যে জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলমান ছিল। সেই অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন কোন কোটা পদ্ধতি না থাকার কথা। তিনি সেখানে খুব আবেগঘন বক্তব্য রাখলেন। অনেক উদাহরণ দিয়ে কথা বললেন তিনি। আবার তিনি এও বললেন যে পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজনে কোটা ছাড়া অন্য কীভাবে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে চাকুরি দেওয়া যায় সে বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। এরইমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবি জানিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি, মানববন্ধন করে চলেছেন। তবে এসব বিষয় নিয়ে এখন অন্যরকম রাজনীতি শুরু হয়েছে। সরকারের মেয়াদের এ শেষ সময়ে এসে এসব আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং করে যাচ্ছে এখনও।

সংস্কার কেন প্রয়োজন সেটার জন্য যদি মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের সন্তান-সন্তুতি ও নাতি-নাতনির কথা বিবেচনা করা হয় তাহলেই বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা যেতে পারে। যখন সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এ সুযোগ দেওয়া হতো তখন ৩০% কোটা হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু যখন সন্তান-সন্তুতিদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হলো তখন সে সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং যখন তাঁদের নাতি-নাতনিদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে সেখানে ছেলের ঘরের নাতি-নাতনি এবং মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনি মিলে সে সংখ্যা একটু বেড়ে গেছে বৈকি। অপরদিকে অন্যসব কোটাসহ দেখা গেছে একটা বিরাট অংশ কোটার জন্য নির্ধারিত রাখতে হচ্ছে, যদিও শেষপর্যন্ত কোটায় খালি থাকা অসনগুলো মেধা থেকেই পূরণ করা হচ্ছে।

এক্ষেত্রে কোটা সংস্কার বিষয়ে নিন্মরূপ একটি প্রস্তাব নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের আর কোন কোটা রাখার প্রয়োজন হবে না। কারণ সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সের সাথে কোন সরাসরি মুক্তিযোদ্ধার বয়স মিলবে না। তবে মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সেজন্য তাদেরকে একেবারে কোটা পদ্ধতি থেকে বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। সেজন্য যেহেতু সরাসরি মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে তাঁদের সন্তান-সন্তুতির সংখ্যা বেশি সেজন্য সন্তান-সন্তুতির জন্য বর্তমানে চালু থাকা ৩০% এর পরিবর্তে ১০% রাখা যেতে পারে।

অপরদিকে নাতি-নাতনির সংখ্যা সন্তান-সন্তুতির চেয়ে আরো বেশি হওয়ায় সেটার জন্য বর্তমানে চালু থাকা ৩০% এর পরিবের্তে ৫% রাখা যেতে পারে। সেটার জন্যও একটি সময় নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে যেখানে আগামী ১০ বা ২০ বছর পর আর সে কোটার কোন কার্যকারিতা থাকবে না। সেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বর্তমানে চালু থাকা যথাক্রমে ৫% ও ১% কোটা বহাল রাখা যেতে পারে। তবে নারী এবং জেলা কোটা আপাতত আর রাখার তেমন কোন যৌক্তিকতা নেই। কারণ বাংলাদেশে এখন নারী শিক্ষার হার প্রায় পুরুষের কাছাকাছি এবং তারা বর্তমানে সাধারণ প্রতিযোগিতাতেও পুরুষদের থেকে তেমন আর পিছিয়ে নেই। আর সব জেলাতেই এখন মেধাবী শিক্ষার হারও বাড়ছে।

এর আগে দীর্ঘদিন যাবৎই এ বিষয়টি এভাবেই বিরাজমান রয়েছে। হঠাৎ করে এবারই কেন এ নিয়ে আন্দোলনে একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠতে হলো এর কোন তাৎক্ষণিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে বর্তমান সরকার কর্তৃক মন্ত্রী পরিষদ থেকে এ সংক্রান্ত যে সংস্কার কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে সেখান থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি সুুনর্দিষ্ট প্রস্তাব পাশ হয়ে আসলে তা যত দ্রুততমভাবে কার্যকর হবে, তবেই দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। সেখানে তা নিয়ে আর অপরাজনীতি করার জন্য কেউ সুযোগ পাবে না। তবে এ কমিটিতে শুধু সরকারি চাকুরির বিষয়টিই এককভাবে না এনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও একটি সৃনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিতে পারেন। এভাবেই এ সংবেদনশীল বিষয়টির আশু সমাধান হওয়া বাঞ্ছণীয়।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer