Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

কৃষকের কণ্ঠ ও একজন ‘হাওর ভূমিপুত্র’

আশরাফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০২:৫৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

কৃষকের কণ্ঠ ও একজন ‘হাওর ভূমিপুত্র’

ছবি : ফারজানা আশা

ঢাকা : স্বাধীনতার পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্যের একটি ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে ঘুরছিল। ভিডিওটি খুব প্রচলিত নয়-এই ভেবে তা মনোযোগ দিয়ে শোনার ও দেখার চেষ্টা করি।

সেই ভিডিওতে বঙ্গবন্ধু চিরচেনা দৃপ্তকণ্ঠে বলছেন, ‘‘আপনি চাকরি করেন-আপনার মাইনা দেয় ওই গরীব কৃষক। আপনার মাইনা দেয় ওই গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন। ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। মনে রেখো এ স্বাধীন দেশ ব্রিটিশ কলোনি নয়-পাকিস্তান কলোনি নয়।’’

সেখানে জাতির জনক সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘‘কিছু মনে করবেন না-একটা কথা জিজ্ঞেস করি আমাদের লেখাপড়া শিখাইছে ক্যাডা? আমাদের বাপ-মা। ডাক্তারি পাশ করায় কে? ইঞ্জিনিয়ার পাশ করায় কে? বৈজ্ঞানিক করে কে? কার টাকায়? বাংলার দুঃখী জনগণের টাকা। আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা-শিক্ষিত ভাইয়েরা-তারা আপনার লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়। দিয়েছেন-তাদের আপনি কাজ করবেন-সেবা করবেন। তারা কী দিয়েছেন-কী ফেরত দিচ্ছেন? কতটুকু দিচ্ছেন? কার টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাব? কার টাকায় ডাক্তার সাব? কার টাকায় মেম্বার সাব? কার টাকায় সব সাব? ...’’

‘কার টাকায় সব সাব?’ বঙ্গবন্ধুর এই প্রশ্ন আমাকে শুধু উদ্বেলিতই করেনি ভেতরকে দারুণভাবে নাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার পরিম-লে খুব প্রচলিত একটি শব্দ ‘ব্রেইন ড্রেইন’ ‘মেধা পাচার’। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের প্রতিটি শব্দের সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করি ‘কী ফেরত দিচ্ছেন? কতটুকু দিচ্ছেন?’

যে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন-গবেষণা করছেন; সেই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের জন্য কিছু না করে বিদেশে বিপুল ঐশ্বর্যের হাতছানি পেয়ে যারা দূরদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কিইবা বলার আছে। তবে এরকম তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতদের বাইরেও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার নজির স্থাপন করার বহু দেশপ্রেমিক আছেন যাঁরাই দেশকে গড়তে ভূমিকা রাখছেন। আমাদের বিবেচনায় প্রয়াত ড. নিয়াজউদ্দিন পাশা তাদেরই সেইসব দেশপ্রেমিকদেরই উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি।

কৃষি প্রকৌশলী হিসাবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করলেও ড. নিয়াজ পাশার চিন্তায় ও কর্মকা-ে বহুমুখিতা ছিল-যার মুলে ছিল গভীর দেশপ্রেম। সত্য উচ্চারণ ও নৈতিকতার প্রশ্নে এতোটাই আপোষহীন ছিলেন তিন-যা তাঁর ব্যক্তিজীবনে সমূহ দূর্ভোগের কারণ হওয়া সত্ত্বেও তাকে সাদরে বরণ করেছেন তিনি।

তিন দশকেরও বেশি সময় কৃষি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকে যে কথাটি সবচে’ বেশি উচ্চারণ করেছেন তিনি-তা হচ্ছে কৃষকের অধিকার। তাঁর চলে যাওয়ার পূর্বে ‘আবার মুক্তার চাচার ফোন: ধানের দাম কী বাড়বো?’ কিংবা ‘দা-ওয়ালদের ভূঁরিভোজ, কৃষকের মুখে হিদল-শুটকি’-এরকম বহু লেখায় তিনি বিপন্ন কৃষকদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন।

কৃষকের কষ্টার্জিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার বহুকালের বঞ্চনার কথা অসংখ্য লেখায় তুলে ধরেছেন তিনি। কৃষকদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে অবিচারের মধ্যস্বত্বভোগীদের বৃত্ত ভাঙতে সব সময় লড়াই করেছেন তিনি। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম লাইমপাশায় জন্ম নেওয়া নিয়াজ উদ্দিন শৈশব ও কৈশোরে খুব কাছ থেকে কৃষকদের সঙ্গে অবিচারের দৃশ্য যেমন দেখেন-তেমনি তাদের মানবেতর জীবনের সবক’টি স্তরের সঙ্গেও সমানভাবে পরিচিত। বিশেষ করে হাওরের বৈরী প্রকৃতিতে তাঁর বেড়ে উঠার অভিজ্ঞতা পরিণত বয়েসে এসে লেখক ও সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে সাহায্য করে ড. পাশাকে।

ড. নিয়াজ পাশার জীবনের বড় অর্জনের মধ্যে একটি হচ্ছে-হাওরের জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার সংগ্রামে সেখানকার কৃষি উৎপাদন ও জীবনযাপনের নানামূখি চ্যালেঞ্জসমূহের বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত সমাধান কৌশল উপস্থাপন। হাওরের একজন অধিবাসী হিসাবে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংকট তিনি যতটা গভীর মমতায় উপলব্ধি করেছেন-তা খুবই মৌলিক বৈশিষ্টের দাবি রাখে।

হাওরের খাদ্য উৎপাদন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনাসহ আদ্যোপান্ত স্পর্শ করেছে তাঁর চিন্তায়। হাওরে ইপিজেড স্থাপন, বিশেষায়িত দমকল বাহিনী গড়ে তোলা, পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো হাওরে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বিশেষ ভাতা চালু, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অসংখ্য সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যন্ত প্রস্তাবনা উত্থাপন করে গেছেন ড. পাশা।

হাওরের সামগ্রিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে তাঁর প্রস্তাবিত এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নির্দেশে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) বাস্তবায়ন হতে যচ্ছে ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’। সম্প্রতি এ ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিয়োগের কথাও জানা গেছে। যদিও নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়ন জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি তিনি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অত্যন্ত স্নেহভাজন হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তি স্বার্থে নিয়াজ পাশা কোনো সুযোগই কাজে লাগাননি। মালয়েশিয়ায় পিএইডি সম্পন্ন করার সময়ে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সমূহ সুযোগকে তুচ্ছ করে ছুটে এসেছিলেন নিয়াজ পাশা। বঙ্গবন্ধুর সেই উচ্চারণ ‘কার টাকায় সব সাব?’ অন্তরে ধারণ করেছিলেন তিনি। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে যে ঋণে দায়বদ্ধ হয়েছিলেন-জীবনের সবচেষ্টায় সেই ঋণ শোধ করে গেছেন তিনি। কৃষকের সন্তান নিয়াজ শিক্ষাজীবনের কৃষি ও কৃষকদের জন্য নিজেকে বিসর্জনের যে ব্রত গ্রহণ করেছিলেন শেষ সময় পর্যন্ত তা রক্ষা করে গেছেন তিনি।

বিনিময়ে পরিবারের জন্য হয়ত কোনো ঐশ্বর্য রেখে যেতে পারেননি তিনি-তবে সন্তানদের জন্য এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গর্ব করার মত আদর্শ রেখে গেছেন তিনি।

দেশের জন্য-কৃষি ও কৃষকদের জন্য যে অবদান রেখে গেছেন ড. পাশা-তার সঠিক মূল্যায়নের দাবি জানাই।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম 

(১৬ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার ফার্মগেটে বিএআরসি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘হাওর ভূমিপুত্র’ ড. নিয়াজউদ্দিন পাশা স্মরণসভায় পঠিত)

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer