ছবি : সংগৃহীত
অনেকের অনেক প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, নাটকীয়তা থেকে রোমাঞ্চকর জাতীয় রাজনীতির নানা অজানা ঘটনা ও গণমাধ্যমে ভিতরের চিত্র এই বইয়ে উঠে আসছে। যদিও সেসব ফেসবুকে দেয়া হবে না। আগামী একুশের বইমেলায় অন্যপ্রকাশ থেকে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে।
জুবিলী স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়ে প্রথমেই যে মজাটি পেয়েছিলাম সেটি হলো, বিশাল পাখা টানার অভিজ্ঞতা। তখন ফ্যান ছিল না স্কুলে। একটি টানা পাখা থাকতো, লম্বা রশির মাথা ক্লাসের পিছনে বসে একজন টানতেন। স্টাফ সংকটের কারণে পাখা টানার লোক নেই। আমরাই প্রতিযোগিতামূলকভাবে ভাগাভাগি করে টানতাম। জলিল স্যার ক্লাস করার ফাঁকে মাথা টিপে দেয়ার জন্য তুহিনকে মাঝে মধ্যেই তলব করতেন। ক্লাস থ্রিতে আমি যাদের সহপাঠী হিসাবে পেয়েছি তাদের মধ্যে তুহিন, সাহার, জুনেদ, মুন্না, বিশু, শান্তিময়, বাবর বখত, ফরিদ, সাদেক, জুলহাস পাঠান, মুকুল, বকুলসহ অনেকে। অনেকে যুক্ত হয়েছে পরবর্তী ক্লাসগুলোতে।
সালাম, কুসুম, ময়না, রেজান, হোসেন এরা ক্লাস সিক্স থেকে এবং ফাইভ থেকে বাবলু, ননী, রজব, ওদদুরা সহপাঠী ছিল। শহরের তেগোরিয়া ও আরপিননগর এই দুইটি এলাকার মাহত্ন যে অন্যরকম সেটি ক্লাস থ্রিতেই বুঝলাম। দুই পাড়ার দুই সহপাঠীর ধাক্কাধাক্কি হয় খবর পেয়ে উপরের ক্লাস থেকে তাদের বড় ভাইয়েরা ছুটে আসেন। ক্লাস ফোরে উঠার পর ক্লাস টিচার হলেন ইউসুফ স্যার। সেটি ১৯৭৪ সাল। তথন রাশিয়ান বাই সাইকেল চালু হয়েছে খুব। আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল যেদিন দেয়া হবে সেদিন সব ক্লাসের ছাত্ররাই টেনশনে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা। যথা সময়ে সব ক্লাসের ফলাফল পেয়ে গেলেও আমাদের ক্লাসের ফলাফল বিলম্বে স্থান নির্ধারণ ছাড়াই দেয়া হয়। প্রাপ্ত নম্বর অনেক বেশি থাকলেও স্থান নির্ধারণীতে জায়গা ফাঁকা থাকায় বাবা ক্ষুব্ধ।
বললেন, তোমার কোন নম্বরই নাই। ধীরস্থির আপা বুঝতে চাইলেন এবং খোঁজ নিলেন। পরদিনই জানানো হলো আমার স্থান তৃতীয়। ক্লাস ফোরের একটি দরজা উন্মুক্ত ছিল স্কুল মাঠের দিকে। এখন সেটি বন্ধ। তখন মাঠে দেয়াল ছিল না। উন্মুক্ত মাঠে এক সেকশনের সাথে আরেক সেকশন বা এক ক্লাসের সঙ্গে আরেক ক্লাসের ক্রিকেট খেলার আয়োজন অনেক করেছি। একদিন দুপুরের পর ফরিদ পাঠানকে শাস্তিমূলক নীলডাউন করে হেড মওলানা স্যার একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। ফরিদ এই সুযোগে খোলা দরজা দিয়ে মাঠের দিকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যায়।
ক্লাস ফোরেই আমাদের সঙ্গে ভর্তি হলো সুন্দর একটি ছেলে। সবার থেকে তার কাপড়চোপড় আলাদা, খাতাগুলোও চাকচিক্যময়। শরীর থেকে পাওডার, পারফিউমের ঘ্রাণ সুবাস ছড়াতো। আমি তাকে দুষ্টুুমি করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা অনেক ধনী। সে সহজ সরল উত্তর দিল, হ্যাঁ আমরা ধনী। অংক মুখস্ত করার চেষ্টা করতো সে। স্কাউট, খেলাধুলায় সেও একটিভ ছিল। তার নাম অপু। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল বারীর ছেলে। বারী মিয়া বলেই তিনি পরিচিত।
ক্লাস সেভেনে সেলিম এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়। এসেই রেজাল্টে কিস্তিমাত করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার বড় দুলাভাই কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার হয়ে এলে সেও তার বড় আপার কাছে চলে আসে। উকিলপাড়ায় সে যে বাসায় থাকতো তার সামনের খোলা জায়গায় আমরা অনেক খেলধুলা করেছি।
কুয়াশার বই আমরা অনেক বিনিময় করেছি। একেকটি বই পড়লে তার পুরো গল্প সেলিম সুন্দর করে বলতে পারতো। সেই সেলিমই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয বিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে।
স্কুল জীবন থেকেই মেলোডিয়াস গলা নিয়ে আসা পৃথিবীতে সেলিম চৌধুরী গান গাইতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষে তার প্রথম অডিও ক্যাসেট হিট হয়। শহিদুল্লাহ হলের হাউজ টিউটর থাকাকালে নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের নজর কাড়ে সেলিম। লেখাপড়ায় ফার্স্ট ডিভিশন ও ফার্স্ট ক্লাস থাকলেও সংগীতের প্রতি প্রেম তাকে টেনেছে। আর কোনোদিকে যাওয়া হয়নি তার। ক্লাস এইটে শাফকাত এসে আমাদের সঙ্গে ভর্তি হয়। উন্নত লেখাপড়ার জন্য প্রান্তিকের ছেলেরা যখন ঢাকামুখী হয়, সেই করুণ যোগাযোগ ব্যবস্থার আমলে শাফকাত যায় সুনামগঞ্জে। লেখাপড়ায় মনোযোগী হবার জন্য তার বাবা সুনামগঞ্জে আমাদের প্রতিবেশি বিহাড়ি ডাক্তার খ্যাত তার চাচার বাসায় তাকে পাঠিয়ে দেন।
স্কুল থেকে বাসায় গিয়ে রোজ যখন দেখে শার্টের পিছনে কলমের ছুঁড়ে দেয়া কালির দাগ, তখন শাফকাত এসে আমার সঙ্গে নিবিড়, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে আবদ্ধ হয়। তখন সিনেমার প্রতি সবারই ঝোঁক ছিল। শহরের একমাত্র নূরজাহান সিনেমা হলে মাঝে মধ্যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ম্যাটিনি শো দেখে যখন বের হতাম, তখন চোখে তীব্র আলোর ঝলকানিতে তাকানো যেত না। ঢাকা থেকে যাওয়া শাফকাতের কাজ ছিলো রোজ বিকালে পাড়ার বিশ্বজিৎকে সিনেমার কাহিনী শোনানো। এমনকি দু’একটি সিনেমায় সে অভিনয় করেছে। এমন গল্প বলে বিশ্বজিতের কৌতুহলও বাড়িয়ে দিতো। শাফকাতের বিয়ের আগ পর্যন্ত তার রাজাবাজারের বাসভবন ছিল আমাদের গণ আড্ডার ঠিকানা। এমন হয়েছে যে, ভোরবেলা একজন বাথরুমে ঢুকলে ফিরে এসে দেখে তার শয্যায় নতুন মেহমান ঘুমিয়ে গেছে। মানে নাইট কোচে এই মেহমান এসেছেন। কে কার মেহমান কেউ জানে না। এমনকি নাস্তার টেবিলে শাফকাতের নিজেরও অনেক মেহমানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।
যাক, ক্লাস এইটে বদের হাড্ডি কাজলকে আমরা সাথে পেলাম। তবলা বাজাতো দারুণ । সংগীত পরিবারের ছেলে কাজলরা হোসেনদের বাসায় ভাড়া থাকতো। তার মাথায় সারাক্ষণ শয়তানি কিলবিল করতো। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমি ছিলাম বেক বেঞ্চার। সামনে বসা মানে দম বন্ধ অবস্থা। ক্লাস নাইনে একদিন প্রথম সারিতে বসেছিলাম। ইতিহাসের স্যার ছিলেন ফজলুল হক। আমি কি কাল!বাপরে ,উনি পাশে দাঁড়ালে নিজেকে শ্বেতাঙ্গ মনে হতো। এতটাই কুচকুচে কালো ছিলেন যে, সেটি বিষয় না। বিষয় ছিল পোশাক। পাতলা ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবির নিচে কটকটে হলুদ সুয়েটার পরেছেন এক শীতের সকালে। ক্লাসে ঢুকতেই সবার সঙ্গে দাঁড়ালাম, আমার তখন হাসি আর হাসি। তিনি আমার সামনে আসলে, কটমট করে জানতে চাইলেন আঞ্চলিক ভাষায়, বেটকাস ক্যান, বেটকাস। আমি ততই হাসি। ক্ষমতা উনাদের একটাই ছিল, হাতের বেত চালিয়ে দেয়া।
এখন সরকার যে আইন করেছে সেটি পশ্চিমা ও উন্নত দুনিয়ায় অনেক আগে বহাল হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক বা মানসিক পীড়ন অপরাধ। আমাদের সময় একজন স্যার ছিলেন বাঘে-ছাগলে এক ঘাটে পানি খওয়াতেন। সারারাত জুয়া খেলতেন, ঘুমহীন কখনো বা পকেট শূণ্য করে উগ্র মেজাজ নিয়ে স্কুলে আসতেন। এমন মার মারতেন! অনেক ছাত্রদের শিক্ষাজীবন স্কুল সীমানাতেই ইতি টেনে দিয়েছেন।
যাক, যে কথা বলছিলাম, ক্লাস এইটে পড়ার সময় একদিন ক্লাস চলার ফাঁকে কাজল এসে গুরুত্বের সঙ্গে খবর দিল জেলা পর্যায়ে নাচের প্রতিযোগিতা হচ্ছে আজ। রূপালী ছাড়া কোনো প্রতিযোগী নেই। তুই আর আমি অংশ নিলেই সেকেন্ড হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে চট্টগ্রাম চলে যাবো।
আমি বললাম, এটা কি ধরণের প্রস্তাব? টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় গেছি। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হাই জাম্পে প্রথম হয়েছি। বার্ষিক মিলাদ মাহফিলে রচনা প্রতিযোগিতায় বিশ্ব নবী থেকে তুলে দিয়ে ২য় হয়েছি। জীবনে গানও গাইনি, নাটকও করিনি, নাচের কথা তো ভাবিইনি। ক্লাসের কেউ শুনে ফেললে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নেবে, এমন গোপনীয়তার সাথে কাজল তরিঘরি বললো; সব ব্যবস্থা আমি করেছি। আমরা শুধু অংশ নেবো আর যুগল নৃত্য করে সেকেন্ড হয়ে যাবো।
শহরের ঐতিহ্যাবাহী সাংস্কৃতিক পরিবারের অনিন্দ্য সুন্দরী রূপালী সরকারি গার্লস স্কুলে পড়তো। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নাচের প্রতিযোগিতায় অসংখ্য পুরষ্কার তার গলায়। ক্লাস থ্রির রুমে প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছে। সংস্কৃতিক বোদ্ধারা বিচারক হয়ে এসেছেন। একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশ। কাজল আর আমি টিফিন কক্ষে গিয়ে পরামর্শ করলাম-আমরা কি নাচবো! এক বোতলে পানিভর্তি করে কাজল বললো, মদ পানের অভিনয় করে আমরা এই পানি মেজেতে ফেলবো আর রূপালি সেখানে আছার খাবে বা পা পিছলে পরে যাবে। এতে আমরা প্রথমও হয়ে যেতে পারি।
স্বাধীনতার পর খাসিয়ারা ফুটবল খেলতে আসতো। কাজলকে বললাম, তাহলে আমাদের নৃত্যের নাম হবে খাসিয়া নৃত্য এবং আমরা টিনের টুকরা দিয়ে দু’খানি তলোয়ার বানালাম। তখন শহরের জনপ্রিয় শিল্পীদের একজন রওনক বখত তবলায়। কাজলের বড় বোন গান গাইতেন। পরে বিসিএস ক্যাডারে সিভিল প্রশাসনে যোগ দেন। রওনক ভাইকে কাজল ব্রিফ দেয়ার পর তিনি সিরিয়াসলি তবলায় তাল উঠালেন। নৃ্ত্যের নামে আমরা নিজেদের ফেলা পানিতে আছাড় খেয়ে খেয়ে প্রতিযোগিতাকে রীতিমতো প্রহসনে পরিণত করলাম। হঠাৎ দেখি, তবলা থেমে গেছে। বিচারকরা গম্ভীর হয়ে রাগত চেহারায় দাঁড়িয়ে গেছেন। একজন বললেন, এসব কি হচ্ছে? যাও, তোমরা ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে গেছো।
আমরা পিছনের সারিতে বসে থাকলাম। রূপালীর নৃত্য মুগ্ধ হয়ে দেখছি। আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আসা শিল্পী ও তাদের অভিভাবকরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখছেন আমাদের।
রূপালী অকালে মারা গেছে। একটি প্রতিভা ঝড়ে গেছে। সে যখন মৃত্যুর আগে অন্ধ, তার বড় ভাই বন্ধু রমার সঙ্গে দেখতে গেলাম। রমা বললো, হাবিব এসেছে তোকে দেখতে। শয্যায় শায়িত রূপালী বললো, এখনো কি সেই আগের মতো শয়তান আছে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে। হার্ট এ্যাটাকে রমাও অকালে চলে গেছে। সেদিন নাচের প্রতিযোগিতা থেকে ক্লাসে যখন ফিরলাম তখন মাসয়ূদুল হাসান স্যারের ক্লাস শেষ পর্যায়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইতেই অগ্নিশর্মা হয়ে জানতে চাইলেন, আপনারা কোথায় ছিলেন? বীরত্বের সঙ্গে বললাম, নাচের প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলাম।প্রচণ্ড রাগ আর বিস্ময় নিয়ে তিনি আমাদের দিকে যেই তাকালেন....
চলবে
লেখক : প্রতিথযশা কলামিস্ট ও বিশিষ্ট সাংবাদিক।
বহুমাত্রিক.কম