Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৯ ১৪৩১, মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪

কারখানা বর্জ্যে বিপন্ন বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, দিশেহারা কৃষক

মোঃ তুহিন আহামেদ, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ২২ মে ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

কারখানা বর্জ্যে বিপন্ন বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, দিশেহারা কৃষক

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

সাভার : গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার হিজলহাটি এলাকায় কয়েকটি শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্যে ও বিষাক্ত পানিতে প্রায় এক হাজার বিঘা ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফসলি জমি যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য বিগত কয়েকবছর আগে স্থানীয় পর্যায়ে তৈরিকৃত সরকারি জমিতে একটি ক্যানেল মাটি ভরাট করে দখলেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কালিয়াকৈর উপজেলার আটাবহ ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের হিজলহাটি এলাকায় স্থানীয়দের প্রায় এক হাজার বিঘার ফসল ওই এলাকার তানজিলা গ্রুপের একটি ইউনিট, হেসং বিডি লিমিটেড, ও আশুলিয়ার স্পার্ক কারখানা থেকে নির্গত দূষিত এবং অপরিশোধিত পানিতে নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে কৃষক ও স্থানীয়রা।

তবে কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তারা ফলপ্রুসু কোন জবাব দিতে পারেনি। এছাড়া তারা একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। আর প্রশাসনের সঠিক তদারকির অভাবের কারণেই কৃষকরা বছরের পর বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে বলে অভিমত সমাজের সচেতন মহলের।

সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় কয়েকটি কারখানার বিষাক্ত পানিতে বিশাল জায়গায় রোপণকৃত ইরি বোরো ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে দূষিত, দূর্গন্ধযুক্ত কালো পানির কারণে ফসলের ফলনে বিপর্যয় ঘটায় ব্যাপক লোকসান গুণতে হয়েছে তাদের। এবছর পুজিঁ খাটিয়ে চাষ করলেও দূষিত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা (২০০৭ সালের দিকে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি জমির উপর তৈরিকৃত ক্যানেল) দখল করার কারণে ফসলি জমির উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। আর এর ফলে ফসলের ফলন তেমন ভাল হয় না। অনেকে আবার ফসল ঘরেও তুলতে পারছে না।

দূষিত পানির পর্যাপ্ততা এতটাই যে স্থানীয় এলাকায় বসবাস করারও যেন উপায় নেই। দূষিত পানির দূর্গন্ধে থাকা দায়। এছাড়া পানিতে থাকে অনেক দূষিত জীবাণু। ফলে ফসল কাটতে গিয়ে পড়তে হয় নানান ধরণের অসুখে।

হিলজহাটি গ্রামের কৃষক খলিল মৃধা বলেন, এবার সে প্রায় ৭০ শতাংশ জমির উপর বোরো ধানের চাষ করেছে। কিন্তু কারখানার দূষিত পানির কারণে বরাবরের মত এবারও তার ক্ষেতে তেমন ভাল ফলন হয়নি। ফলে বিশাল অংকের পুঁজি খাটিয়েও লোকসানই গুনতে হবে তাকে।

ফসলের ফলনের এমন নাজেহাল অবস্থার কারণ হিসেবে তিনি ফসলের জমির পাশে তৈরিকৃত ক্যানেল স্থানীয় আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের হাউজিং প্রজেক্টের জন্য মাটি ভরাট করে দখল করাকেই দোষছেন। কেননা অনেক আগে যখন ক্যানেল চালু ছিল তখন ফসলি জমির উপর দিয়ে কোন পানি প্রবাহ হতো না। কিন্তু এখন মাটি ভরাট করে ক্যানেলটি দখল করার কারণে ক্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায় ফলে কারখানার দূষিত পানি ফসলি জমির উপর দিয়ে প্রবাহের কারণেই ফসলের ফলনের এমন অবস্থা বলেও তিনি জানান।

ফসলির জমির বিভিন্ন স্থানের কয়েকটি কোম্পানি জমি ক্রয় করে সেখানে মাটি, বালু ফেলছে। কিন্তু ক্রয়কৃত জমির সীমনা ছাড়িয়ে বালু অন্য জমিতে গিয়ে পড়ছে। কৃষকেরা বারবার অভিযোগ করেও এর কোন সুরাহা করতে পারেনি। অনেক সময় বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ফসলি জমি বিক্রি করতে হুমকিও প্রদান করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।

হিজলহাটি গ্রামের মো: আনিছুর রহমান খোকন মৃধা জানান, সরকারি জমির উপর যে পানি নিষ্কাশনের জন্য ক্যানেল তৈরি করা হয়েছিল তা এখন পুরোপুরি ভাবে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ থাকার কারণ হিসেবে তিনি মাটি ভরাট, স্থানীয় কৃষকের কাছ থেকে জমি হাতিয়ে নেয়ার একটি পরিকল্পনাকেই দায়ী করছে। তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি করেন, অতি দ্রুত যাতে সরকারি জমি উদ্ধার করা হয় সেই সাথে ক্যানেলটি যাতে পুনরায় সচল করা হয়।

স্থানীয় কৃষক জমশের জানান, কারখানার ছেড়ে দেওয়া দূষিত পানিতে বোরো ধান ক্ষেত তলিয়ে আছে। একদিকে ফসলের ফলন ভাল না হওয়া এবং এবার শ্রমিকের মজুরির পরিমাণ বেশি থাকায় ধান কেটে ঘরে তোলার কোন উপায় নেই। পচাঁ ধান নিয়ে খুবই সমস্যার মধ্যে আছি। তিনি আরো জানান, ফসলির জমির পাশে পানি নিষ্কাশনের যে ক্যানেলটি রয়েছে তা যদি পুনরুদ্ধার করা যায় তাহলে ফসলের ফলন ভাল হবে। আমরা কৃষকরা পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো।

এ বিষয়ে স্থানীয় কয়েকটি কারখানার কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে সরকারি নিয়ম মোতাবেক কারখানা পরিচালনা করা হচ্ছে। যে পানিটুকু বাইরে যাচ্ছে সে পানি দূষণ মুক্ত করার পরই বাইরে ছাড়া হয়। তবে জমির ধান নষ্ট হচ্ছে এমন অভিযোগের কথা বললে তারা একে অন্যের উপর দোষারোপ করতে থাকে। তবে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে তারা।

গাজীপুর জেলা পরিষদের ১নং ওয়ার্ড (কালিয়াকৈর উপজেলার আটাবহ, ঢালজোড়া ও শ্রীফলতলী ইউনিয়ন) সদস্য মো: ফালাক উদ্দিন মৃধা বলেন, তৎকালীন সময়ে ২০০৭ সালের দিকে আমি যখন উপজেলার আটাবহ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার ছিলাম তখন হিজলহাটি মৌজায় প্রায় এক হাজার বিঘা নিচু ফসলি জমির উপর দিয়ে যাতে পানি প্রবাহিত না হয় সেজন্য স্থানীয়দের নিয়ে এবং ওই এলাকায় স্থাপিত হেসং বিডি লিঃ এর আর্থিক সহযোগিতায় সরকারি জমির উপর প্রায় ১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ক্যানেল তৈরি করা হয়।

পরে ওই এলাকায় আরো কয়েকটি পোশাক কারখানা গড়ে উঠে। এতে করে কারখানা থেকে নির্গত পানির প্রবাহ বাড়তে থাকে। এরই একপর্যায়ে ফসলি জমির এক পাশে হাউজিং প্রজেক্টের একটি প্রতিষ্ঠান জমি ক্রয় করে সেখানে বালু ফেলতে থাকে। পরে তারা ক্যানেলটি ভরাট করে দখল করে। ফলে কারখানার দূষিত পানি ফসলের জমি দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। আর এতে করে ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এলাকাবাসী বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে আমার কাছে অভিযোগ করে। তবে এ বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার বলা হলেও বিষয়টি নিয়ে তাদের কোন ফলপ্রুসু উদ্যোগ দেখা যায়নি। তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি জানান, সরকারি জমির উপর নির্মিত যে ক্যানেলটি রয়েছে তা যেন পুনরুদ্ধার করা হয়।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer