Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

ঐতিহাসিক মন্দিরময় পাথরা ও একজন ইয়াসিন পাঠান

অনিন্দ্য দাস

প্রকাশিত: ১৩:৩৮, ১৬ জুন ২০১৮

আপডেট: ১০:১৭, ১৯ জুন ২০২৩

প্রিন্ট:

ঐতিহাসিক মন্দিরময় পাথরা ও একজন ইয়াসিন পাঠান

ছবি : লেখক

কলকাতা : বর্তমান সমাজে যখন চারপাশে চলছে ভয়াবহ অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা, তখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মিলেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মেদিনীপুরের পাথরায়। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই পাথরা হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের পীঠস্থান।

প্রথমে দেখে নেওয়া যাক পাথরার ইতিহাস। আলীবর্দি খাঁ তখন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব এবং তার রাজধানী মুর্শিদাবাদ। তার অধীনে তখন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কয়েক হাজার পরগণা। এই কয়েক হাজার পরগনার প্রত্যেকটিতে তিনি একজন করে নায়েব তথা মুস্মাদার নিযুক্ত করেছিলেন ওই পরগনার রাজস্ব আদায়ের জন্য। তেমনই এক পরগনার ছিল রতনচক। এই রতনচক পরগনায় নবাব আলীবর্দি খাঁ নায়েব নিযুক্ত করেন ভাটপাড়া ব্রাহ্মণ কুলের সন্তান রাঘবরাম ঘোষালকে।

কথিত আছে, এক বার্ষিক খাজনা আদায়ের প্রাক্কালে রতনচক পরগনায় এসে উপস্থিত হন রাঘবরামের কুলগুরু। এই সময় আদায়কৃত সমস্ত খাজনা মুর্শিদাবাদে নবাবকে পাঠানোর পরিবর্তে তিনি তার কুলগুরুকে উৎসর্গ করেন। কিন্তু কুলগুরু তা নিতে অস্বীকার করেন, কারণ তা জনগণের অর্থ-যা কিনা জনহিতকর কাজে নবাব খরচ করেন। কিন্তু রাঘবরাম তার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন এবং ওই খাজনা নবাবকে পাঠাতে অস্বীকার করেন। কুলগুরু শিষ্যের অনুরোধ উপেক্ষা না করে শিষ্যকে শর্তারোপ করেন ও ওই অর্থ নিতে সম্মত হন।

কুলগুরুর শর্ত ছিল, বংশপরস্পরা ধরে এই রতনচক পরগনায় কিছু উন্নয়নমূলক ও ধর্মীয় কাজ করে যেতে হবে। তারই ফলস্বরূপ এখানে হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।

এদিকে নবাব খাজনা লুটের অভিযোগে রাঘবরামকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান এবং শাস্তি স্বরূপ সমগ্র শহর ঘুরিয়ে এক প্রকাণ্ড প্রান্তরে হাত ও পা বেঁধে এক পাগলা হাতির সামনে ফেলে রাখেন। কিন্তু পাগলা হাতি তিন তিনবার তাকে পদপিষ্ট না করে অতিক্রম করে চলে যায়। রাঘবরাম নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান।

এই ঘটনায় নবাব আশ্চর্যান্বিত হয়ে সত্য ঘটনা জানতে পারেন এবং রাঘবরামকে মুক্ত করে তাকে পদোন্নতি দান করে রতনচক পরগনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। রাঘবরাম ঘোষালের মৃত্যুর পর তার ছেলে বিদ্যানন্দ্য ঘোষাল এই পরগনার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। বিদ্যানন্দ্য ঘোষাল এই পরগণার নতুন নামকরণের সিদ্ধান্ত নেন এবং নতুন নাম রাখেন পাউথরা যা শব্দ অপভ্রংশে আজকের পাথরা।

বর্তমানে এই পাথরা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কাঁসাই নদীর তীরে অবস্থিতি একটি ছোট্ট গ্রাম। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশরা ১৩২ টি পরগনা নিয়ে অখণ্ড মেদিনীপুর জেলা গঠন করে। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, ব্রিটিশ শাসনের আগে এই মেদিনীপুর জেলার কোনও অস্তিত্ব ছিল না।

এবার আসা যাক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের মেলবন্ধন প্রসঙ্গে। শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৭২ সালে, এই পাথরা গ্রামের সর্বমোট ৩৪ টি হিন্দু মন্দিরকে সংরক্ষণ করার তাগিদ অনুভব করে গ্রামবার্তা নামক একটি পত্রিকার প্রবর্তন করেন এই গ্রামেরই তিনজন যুবক-বাদল কিশোর ভুঁইয়া, আবদুল সাত্তার খান ও ইয়াসিন পাঠান।

ধারাবাহিক ভাবে তারা তিনজন মিলে পাথারার ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেন ও স্থানীয় অধিবাসীদের অবহিত করতে থাকেন। পরবর্তীকালে ইয়াসিন পাঠান যিনি পেশায় স্থানীয় একটি হাইস্কুলের দপ্তরী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মুলত তাঁর একক প্রচেষ্টায় এক ঐক্যবদ্ধ আন্দলন শুরু হয় এই মন্দিরগুলিকে সংরক্ষণের জন্য। এতে ইয়াসিন পাঠানের কপালে জোটে দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনা। যা কিনা শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে পৌছায় যে ইয়াসিন পাঠানকে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা নিগৃহীত হতে হয়। এমনকি তিনি সেখানকার অধিবাসীদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে তিনি প্রহৃতও হন। তবুও তিনি থেমে থাকেননি।

এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, এই গ্রামের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষজন তাদের বাসস্থান তৈরি করেছেন মন্দিরের ব্যবহৃত ইট দিয়ে। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। ঘটনাটি হল, ১৯৮৩ সালে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা এখানকার প্রাচীন দুর্গা মণ্ডপের ব্যবহৃত পাথরগুলি বিক্রি করবেন বলে মনস্থির করেন এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের মাওয়া নামক জায়গায় কালি মন্দির স্থাপনের কাজে এই পাথরগুলিকে গোপনে পাচার করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ঘটনাটি জানাজানি হলে ইয়াসিন পাঠান তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করেন।

ইয়াসিন পাঠান ১৯৯১ সালে হিন্দু-মুসলিম আদিবাসী সম্প্রদায় নির্বিশেষে গঠন করেন পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটি। এর ফলে আন্দোলন গতি পায়। এই প্রসঙ্গে তিনি জানান, এই মন্দির সংরক্ষণ আন্দোলনের সূচনা প্রথম যথার্থ রূপ পেয়েছিল ১৯৭৪ সালে বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ব পরিব্রাজক তারপদ সাঁতরার পাথরা ভ্রমণকালে।

-ইয়াসিন পাঠান। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণেই যার কেটেছে সারা জীবন

১৯৯৩ সালে ইয়াসিন পাঠান তার অভিজ্ঞতার নিরিখে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা ‘মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত’ নামে প্রকাশিত হয়। বইটি সর্বশেষ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। তার এই কর্মকাণ্ড ও অবদানের জন্য ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ শঙ্কর দয়াল শর্মা তাকে ‘সন্ত কবি’র পুরস্কারে ভূষিত করেন। এই সন্ত কবির পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গের আর কোন ব্যক্তি এখনও পাননি।

ইয়াসিন পাঠানের নিরলস প্রচেষ্টা ও ত্যাগের ফলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রণব মুখার্জী ২০ লাখ টাকা প্রদান করেন পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটিকে। এর ফলে সংরক্ষণের কাজে গতি বৃদ্ধি ঘটে এবং সর্বশেষ ২০০৩ সালে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ পাথরায় ৩৪ টি মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করেন এবং সংরক্ষণ পক্রিয়া শুরু করেন।

ইয়াসিন পাঠানের এই অসামান্য অবদানে পাথরা আজ এক ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পর্যটন কেন্দ্ররূপে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ইতিহাস মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। সারা বছর ধরে ভ্রমণ পিপাষু মানুষ পাথরায় ঘুরতে আসেন ও সরেজমিনে উপলব্ধি করেন পাথরার ইতিহাস ও ইয়াসিন পাঠানের দীর্ঘ সংগ্রাম।

বর্তমানে ইয়াসিন পাঠান শারীরিকভাবে অসুস্থ। বয়স প্রায় ৭০ ছুঁই ছুঁই। বর্তমানে তিনি মাদ্রাজ শহরের অ্যাপেলো হাসপাতালের ডাক্তারদের অধীনে চিকিৎসারত।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ইয়াসিন পাঠান তার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ফেরত দিতে চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। এটা ছিল সরকারের পাথরা সংক্রান্ত পুরাতত্ত্ব যথাযথভাবে সংরক্ষণ না হয়ার ও সামগ্রিক অস্থিরতার প্রতি তার প্রতিবাদ। তার এই আবেদন সরকার পত্রপাঠ খারিজ করে দেয় এবং তাকে আশ্বস্ত করেন যে মন্দিরগুলির যথার্থ সরক্ষণ ও জমি অধিগ্রহণ নিশ্চিত ভাবে হবে।

বর্তমানে এই মন্দিরগুলো সংরক্ষণের কাজের জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া সরাসরি গ্রামবাসীদের সাথে যোগাযোগ করেছে জমি ক্রয়ের জন্য এবং মন্দির সংরক্ষণের কাজ গতি পেয়েছে।

ইয়াসিন পাঠান এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হয়েও যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মন্দিরগুলিকে সংরক্ষণ করার জন্য তার জীবনের অধিকতর সময় ব্যয় করে চলেছেন তা সমগ্র ভারতবাসীর কাছে এক অভিনব দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো।

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer