Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

একজন পথিকৃৎ কৃষি সাংবাদিকের প্রস্থান

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

একজন পথিকৃৎ কৃষি সাংবাদিকের প্রস্থান

মাত্র ৫৩ বছরের জীবন তাঁর। এরইমধ্যে রেখে গেছেন অসংখ্য গুণগ্রাহী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও শুাভানুধ্যায়ী। তিনি সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ৯ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২.১৫ ঘটিকায় চলে যান না ফেরার দেশে। অবসান হলো একটি কর্মময় অধ্যায়ের।

মো. নিয়াজ উদ্দিন এখন থেকে পঁচদশক আগে দেশের অবহেলিত হাওরাঞ্চল কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার লাইমপাশা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। আজীবন মেধাবী এ ব্যক্তিত্ব কিশোরগঞ্জ থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বৃহত্তর ময়মনসিংহের গর্বিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি প্রকৌশল অনুষদে ভর্তি হন।

সর্বদা সদালাপি ও সামজিক মন-মানসিকতা সম্পন্ন এ ব্যক্তি তাঁর নিজের স্বভাবগতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক ও সাস্কৃতিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত হতে থাকেন। তাঁর নিজ এলাকা হাওরের প্রতি ছিল প্রবল টান ও অনুভূতি। সে কারণেই সার্টিফিকেটের নাম মো. নিয়াজ উদ্দিনের সাথে তাঁর জন্মস্থানের নিজ গ্রামের ‘লাইমপাশা’ নামের শেষাংশ জুড়ে দিয়ে তিনি পরিচিত হতে থাকেন নিয়াজ উদ্দিন পাশা নামে। পরে তা নিয়াজ পাশা এবং তিনি প্রিয় পাশা নামেই বেশি পরিচিত লাভ করেছিলেন।

তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা সমিতি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। গড়ে তুলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভিন্ন ধারার সাংবাদিক সমিতি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন একাধিকবার সাংবাদিক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং তিনি তার দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে সকলের সুদৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হয়েছিলেন। পাশা ভাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার আইডল। আজকে এইযে আমি কিঞ্চিৎ লেখালেখির সাথে যুক্ত রয়েছিম সেটাও প্রকারান্তরে পাশা ভাইয়ের অবদান।

শুধু আমি নই, এমন আরো অনেক ছাত্রকে তিনি সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তারপর তিনি আস্তে আস্তে জড়িত হন সে সময়কার আশির দশকের সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতিতে। সেখানেও পাশা ভাই ছিলেন সফল। তিনি সকলের মন জয় করতে পারতেন অতি সহজেই। সেজন্যই তিনি তার আবাসিক হল শেরে বাংলা ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদে স্বাধীনতা স্বপক্ষের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নমিনেশনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দায়িত্ব পালনে সেখানেও তিনি ছিলেন সফল।

পরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গষেণা ইনস্টিটিউটে (বিনা) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এক পর্যায়ে সরকারি বৃত্তি নিয়ে এ মেধাবী কৃষি প্রকৌশলী ও কৃষি বিজ্ঞানী মালয়েশিয়া হতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পরেও তিনি কৃষি সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে আরো বেশি মনোনিবেশ করেন। লেখালেখিতে আরো বেশি সম্পৃক্ত থাকার মানসে তিনি বিনার চাকুরি ছেড়ে ঢাকায় ফার্মগেটে সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টারের সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে নতুন করে কর্মজীবন শুরু করেন।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করে আসা দৈবাৎ একটি ঝড়ে পাশা ভাইয়ের জীবনটা দুর্বিষহ করে দিল। পাল্টে গেল জীবনের সব হিসেব-নিকেশ। পায়ে দেখা দিল গ্যাংরিন নামক পঁচন রোগ। কেটে ফেলতে হলো তার দুটি পা-ই। ইতিমধ্যে ঝেঁকে বসেছিল তার শরীরে নানা জটিল থেকে জটিলতর রোগগুলো। তবে সে যাত্রায় পা কেটে রক্ষা পেলেও, এবার আর শেষরক্ষা হলো না।

২৫ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে একটি ম্যাসিভ ব্রেইন স্ট্রোকের মাধ্যমে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বামপাশ অবশ হওয়ার পাশাপাশি তিনি প্রায় দুই সপ্তাহ সংজ্ঞাহীন থেকে ১০ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে মৃত্যুকুলে ঢলে পড়েন। দুই পা কাটা গেলেও তিনি ছিলেন লেখালেখিতে সব সময়ই সরব। ছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। একদিন ঢাকা তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়ে কথা বলার সময় তিনি বললেন, ‘লেখালেখি করছি বলেইতো আমি এখানো নিয়াজ পাশা’। এত অদম্য ছিল তার গতিপ্রকৃতি।

শেষ সময়ে তিনি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ফারজানা আশার উপর খুবই নির্ভরশীল ছিলেন। তিনিও পাশা ভাইকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদেরও তিনি ছিলেন স্নেহাম্পদ। তিনি সংজ্ঞাহীন থাকার সময় পরিবারের পক্ষথেকে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করতে গেলে, তিনি তার চিকিৎসার সার্বিক খোজ-খবর নেন এবং সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি।

তিনি পিছিয়ে পড়া হাওরের জন্য সারাক্ষণ চিন্তিত থাকতেন এইভেবে যে, কীভাবে পরিকল্পিতভাবে এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন করা যায়। সেজন্য যেমনি করে তিনি কলম চালিয়েছেন, আবার চালিয়েছেন প্রয়োজনীয় যোগাযোগ। এতে তিনি অনেক সফলতাও পেয়েছিলেন। তিনি নিজেকে একজন ‘হাওর ভূমিপুত্র’ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। বর্তমানে গঠিত হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনে তার অনেক অবদান ছিল।

সেইসাথে গতবছর (২০১৬) তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে হাওর কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখেন। তারই স্বীকৃতি হিসেবে এবছর কিশোরগঞ্জের একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা হতে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ এওয়ার্ডও পেয়েছিলেন। তিনি আরো বেঁচে থাকলে পিছিয়ে পড়া হাওরাঞ্চলসহ সারাদেশের কৃষিতে অরো অনেক অবদান রাখতে পারতেন।

আজকের এ দিনে আমার প্রিয় এ কৃষি সাংবাদিককে নিয়ে লিখতে হবে তা কখনো চিন্তাই করিনি। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টাওে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। আজকের এ দিনে তাই পাশা ভাইকে সশ্রদ্ধ সালাম, আপনি মরেণ নাই। আপনি বেঁচে থাকবেন আপনার কর্মের মাধ্যমে।

লেখক: কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer