Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

এক হাতে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে শিশু ইসমাঈল

তুহিন আহামেদ, গাজীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০২:৫৫, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

এক হাতে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে শিশু ইসমাঈল

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

গাজীপুর : যে বয়সের ছেলে-মেয়েরা বই খাতা নিয়ে আনন্দে স্কুলে যায়, বাড়িতে আনন্দে হেসে খেলে বড় হয়, সে বয়সেই সংসারের চাকা হাতে নিয়েছে প্রতিবন্ধী শিশু ইসমাঈল হোসেন (১০)।

এক হাতে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে সে। জন্মগতভাবে সে প্রতিবন্ধী নয়। দেড় বছর আগে এক দূর্ঘটায় তার একটি হাত চলে যায়। সেই থেকে সে শরিরীক প্রতিবন্ধী হিসেবেই পরিচিত। মাদ্রাসায় পড়তো বলে এক সময় তার স্বপ্ন ছিল সে কোরআনের হাফেজ হয়ে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জল করবে।

ইসমাঈল হোসেন গাইবন্ধা জেলার গোবিন্ধগঞ্জ থানাধীন রড়শ্যাম গ্রামের জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী নজরুল ইসলামের ছেলে। সে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চান্দরা পল্লীবিদ্যুৎ ভুট্রো মিয়ার বাড়িতে বাবা-মায়ের সাথে থেকে এ এলাকার বিভিন্ন সড়কে রিকশা চালায়। রিকশা চালিয়ে যা পায় তা দিয়ে পুরো সংসার চালায়। বলতে গেলে সংসারের কর্তাই এখন সে।

কথা হয় প্রতিবন্ধী ইসমাঈল হোসেন এর সাথে। সে জানায়, বছর দেড়েক আগে সে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানাধীন দশনাল জানকুর হাফিজিয়া মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল। নিয়মিত মাদ্রাসায় যেত, নিয়মিত নামাজসহ কোরআন তেলাওয়াত করতো। স্বপ্ন ছিল তার সে কোরআনের হাফেজ হয়ে বাবা-মায়ের মূখ উজ্জল করবে। কিন্তুু তা আর হয়ে উঠল না তার। কোরআনের হাফেজ হওয়ার স্বপ্ন তার ভেঙ্গে গেল।

বছর খানেক আগের কথা, মাদ্রাসায় যাচ্ছিল ইসমাইল। হঠাৎ পথিমধ্যে পেছন দিক থেকে আসা একটি যাত্রীবাহি শ্যালো ইঞ্জিন চালিত টমটম এসে তাকে ধাক্কা দেয়। একপর্যায়ে চলন্ত টমটম তার উপর দিয়ে উঠে যায়। এতে সে গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় গুরুতর আহত অবস্থ্য়া তাকে উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়।

হাতে প্রচুর রক্তক্ষরণ ও হাতের উপর দিয়ে টমটমের চাকা উঠে যাওয়ায় তা এক সময় পচন ধরতে থাকে। একপর্যায়ে সু-চিকিৎসার স্বার্থে চিকিৎসকরা তার শরীর থেকে বাঁ হাতটি কেটে ফেলেন। সেই থেকে এক হাত মানে ডান হাত দিয়েই নিজের ও সংসারের সমস্ত কাজ কর্ম করে থাকে। এমসনকি এ একটি হাত দিয়ে সে দিনভর রিকশা দিয়ে মানুষের যাতায়াত করিয়ে থাকে।

এরপর সে মোটামোটি সুস্থ্য হলে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার পল্লীবিদ্যুৎ মন্ডলপাড়া এলাকার ভুট্রো মিয়ার বাসা বাড়িতে তার বাবা নজরুল ইসলাম, মা শিল্পী বেগম ও ছোট দুই ভাই ইউসুফ (৭) এবং মূসা (৪) এর কাছে চলে আসে।

ইসমাঈল জানায়, তার বাবা জন্ম থেকেই পঙ্গু থাকার কারণে তার মা একটি পোশাক কারখানায় চাকুরি করতো। কিন্তু দুই বছর আগে সে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝিয়ের কাজ করতে থাকে। ঝিয়ের কাজ করে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলেনা তাদের। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে চান্দরা পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার একটি গ্যারেজ থেকে ব্যাটারি চালিত রিকশা ভাড়া নিয়ে তা চালাতে থাকে।

রিকশা চালিয়ে তাকে এখন সংসারে পুরো দায়িত্ব পালন করতে হয়। ছোট ভাই ইউসুফ বগুড়ার একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। তার খরচও দিতে হয় রিকশা চালানোর টাকা থেকে। রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন ৩ থেকে সাড়ে ৩শ টাকার মত হয়। এ থেকে আবার রিকশার জমা বাবদ ২৫০ টাকা দিতে হয় রিকশার মালিককে। এরপর যা থাকে তাই দিয়ে সংসার চালাতে হয়।

ইসমাঈল আরো জানায়, পড়াশোনা করা ইচ্ছা তার এখনো আছে। সুযোগ পেলে সে পড়াশোনা করবে। কিন্তু পিতা-মাতার অভাবের সংসার লেখাপড়ার খরচ দিবে কোথা থেকে ছলছল চোখে সে জানায়। একপর্যায়ে কিছুটা নীরব থেকে আবার বলে উঠে আমি কোরআন শরীফ পড়তে পারি। এপর্যন্ত ৫/৬ বার কোরআন শরীফ খতম দিয়েছি। হাস্বোজ্জল মুখে সে বলে আবার মাদ্রাসায় পড়তে ইচ্ছে করে।

রিকশা চালিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করে আবার সে পড়াশোনায় মনযোগ দিবে বলেও জানায়। তার সবচেয়ে বড় ইচ্ছার কথা জানায়, রিকশা চালিয়ে টাকা জমিয়ে গ্রামের বাড়িতে একটু জমি কিনে তাতে ঘর করে দিবে তার বাবা-মাকে।

পড়াশোনা করে তার হাফেজ হওয়ার স্বপ্ন ছিল বলেও জানায় সে। কিন্তু পরিবারের অভাব আর অনটনের মধ্যে তার পড়াশোনার খরচ দিতে না পাড়ায় তার স্বপন্ পূরণ হলো না।

রিকশায় যাত্রীরা উঠলে অনেকে দয়া-মায়া করে ১০/৫ টাকা বেশী দেয়। আবার অনেকে আমার রিকশায় উঠতে চায়না। বলে তুইতো এক হাত দিয়া রিকশা চালাস দূর্ঘটনা ঘটাবি।

ইসমাঈলের পিতা নজরুল ইসলাম জানায়, ‘‘জন্মগতভাবে আমি পঙ্গু হওয়ার কারণে ছেলেদের পড়ালেখা করাতে পারিনি। ওর মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে যা পায় তা দিয়ে সংসার চলেনা। তাই ছেলে ইসমাঈল বাধ্য হয়ে রিকশা চালাতে যায়। কিন্তু সহযোগিতা পেলে অবশ্যই ছেলেদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুসের মত মানুষ করবো।’’

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer