ড. আজাদুর রহমান মূলত কবি, কবিতাই তাঁর প্রিয়তম বাহন। ছবি যেমন মনের কথা বলে তেমনি কবিতাও অবলীলায় মনের কথা বলতে পারে। শব্দ শিল্পের সূক্ষ্মতাতি সূক্ষ্ম প্রয়োগের মাধ্যমেই সে শিল্পকে সার্বজনীন করে তুলতে হয়। আর এ ক্ষেত্রেও কবি ড. আজাদুর রহমান এর কবিতার জুড়ি নেই। এটা স্পষ্ট যে, কলম দিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন কাগজে আঁকাবাঁকা টান দিলেই যেমন তা চিত্রকর্ম হয়ে যায় না তেমনি যেমন খুশি কবিতায় শব্দ বসালেই তা কবিতা হয়ে যায় না। কবিতার পাঠে অন্তর্গত উপলিব্ধর বিষয়টা বোধহয় একটু বেশি জরুরি। আর এজন্য দরকার সচেতন একাগ্রতা।
গ্রন্থ শিরোনামের মত গ্রন্থভূক্ত কবিতাগুলোর ধরনধারণ, করণকৌশল, বিশ্বাস-বক্তব্য সবকিছু খুবই স্বতন্ত্র ও অভিনব। এ গ্রন্থের আশির্বাণীতে মুহম্মাদ ইমদাদ লিখেছেন যে, প্লাষ্টিকসভ্যতায় দাঁড়িয়ে সনাতন সুন্দর পৃথিবীর জন্য তাঁর কবিতাগুলো কাঁদে। সত্যি তার কবিতাগুলোতে যেমন আছে চিন্তার নতুনত্ব, ভাবনার সজীবতা, উপস্থাপনার অভিনবত্ব তেমনি আছে শব্দপ্রয়োগ ও ভাষাব্যবহারের মৌলিক স্বাতন্ত্র্যতা।
বাংলা সাহিত্যে কবিতার প্রাচুর্য আছে, সমালোচনার আছে দৈন্য। সমালোচনার এই দৈন্য ঘোচাতে কেউ এগিয়ে আসেন না। কেননা প্রত্যেকেই ‘জীবনানন্দ’ হওয়ার বাসনা রাখেন। কেউ চান না ‘বুদ্ধদেব বসু’ হতে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সমালোচনা লিখলেই সৃষ্টিশীল জায়গা থেকে একজন দূরে সরে যান, এই নিরন্তর ভয় নিয়েই একজন নতুন কবি কাব্যজগতে সচল থাকেন। ফলে সমালোচনা-সাহিত্যের অপ্রতুলতা বেড়েই চলেছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সমালোচনার নামে যা হয়, তা হলো বুক রিভিউ।
সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে মননশীলতার প্রাজ্ঞ বিবেচনা না থাকলে একজন বড় কবি হিসেবে স্বীকৃত পান না। বাংলাদেশের কাব্য সাহিত্যে হৃৎপিণ্ডকে বহুলাংশে স্পন্দিত করেছেন ড. আজাদুর রহমান। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচ। ষষ্ঠ বইটি একটি কাব্যগ্রন্থ, যার শিরোনাম, ‘ব্যাগভর্তি রাতের করতালি’। এ বইটির কিছু স্বকীয় কবিতা, দৃষ্টিকোণ এবং সমালোচনারীতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফলে তাঁর বইটি নিয়ে কিছু লেখার দায় অনুভব করেছি।
বইটির উৎসর্গ পত্রে লেখা আছে ‘পৃথিবীতে যারা আনন্দ দান করেছেন তাদের সকলকে’। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জীবনের স্বতস্ফূর্ত থেকে বাস্তবের খরখরে মাটিতে অংকুরোদগম হয়েছে কবির কবিতাগুলি। একজন লেখকের জীবনে একটা লেখাই যেমন তাকে স্মরণীয় করে রাখে তেমনি কবিতায় একটি লাইন বা শিরোনামই যথেষ্ট পুরো কবিতার জন্য। ‘শস্যের জন্য, ফুলের জন্য’ কবিতার শিরোনামটি যেন তেমনি। যেন, কবিতার আত্মা, প্রাণভ্রমরা। এখানেই ড. আজাদুর রহমানের কবিতার স্বার্থকতা। শব্দের ঝনঝনানী নেই। প্রতিদিন যে সকল শব্দ ব্যবহার করি, মনের ভাব প্রকাশ করি, কথা বলি সেই সব শব্দ-কথামালাই কবি তার মতো করে আমাদের কাছে উপস্থাপণ করেছেন।
কবিদের কাজই হল শব্দ নিয়ে খেলা করা। এজন্যই হয়ত মাইকেল মধুসূধন দত্ত বলেছিলেন, শব্দে শব্দে বিয়ে দেয়াই হচ্ছে কবিতা। এ বইয়ের লেখক সূক্ষ্ম চেতনাবাহী অনুসন্ধিৎসু মন সেই অন্তরালাবর্তী সত্যকে সনাক্ত করেই শব্দের মালা গেঁথে সৌধ নির্মাণ করেছেন অবলীলায়। কবির কবিতায় সে শব্দের নিপুন ব্যবহারের পাশাপাশি বিশ্বম-লের পরিচিত অপরিচিত উপকরণেরও সার্থক প্রয়োগ রয়েছে। পরিচিত উপকরণকে হৃদয়ে ধরে রাখার জন্য আর অপরিচিত উপকরণকে শিল্পের ছোঁয়ায় পাঠক মহলে নতুন করে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
কবিতা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প। আর শিল্প কারো কাছে দায়বদ্ধ নয়। যদিও ক্ষেত্র বিশেষ শিল্পীর দায়বদ্ধতা থাকে। অর্থাৎ কবিতা দায়বদ্ধ হতে না পারে কবিতার স্রষ্টা যিনি তিনি অবশ্যই অবশ্যই কোন না কোন ভাবে দায়বদ্ধ! কবি আজাদুর রহমান যদিও কোন প্রকার দায়বোধ থেকে কবিতা লেখেননি, নিছক শিল্পের বাগান সৃষ্টিই তাঁর মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল তবুও তার কবিতা যেন দায়বদ্ধতারই স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ।
সোনার তরী কবিতা সম্পর্কে রবি ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলে, সেখানে বর্ষার চিত্র ছাড়া কিছুই বিস্তার করেননি। অথচ সাহিত্যের অধ্যাপকেরা এই কবিতা নিয়ে ইহকাল আর পরকাল একাকার করেছেন। কবিতা বিশ্লেষণ পাঠক মাত্রেই ভিন্ন ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রকৃত সত্য ও সুন্দরকে ছাপিয়েই গেলেই তা দৃষ্টিকটু বলে গণ্য হবে। এ চরম বাস্তবতার নিরিখে কবির উপলব্ধিতে সত্যের অকপট প্রকাশ আজ এই উত্তরাধুনিকতাকে ঐতিহ্যের নবরূপে বিকশিত করেছে। কবিতায় কবিমানস বুঝাই মুখ্য বিষয়। কবিমানস ডুবে থাকে শব্দের গহীন থেকে গহীনে। ব্যক্তিকে সমষ্টিতে যুক্ত করার সংগ্রামে আবর্তিত হয় চিন্তা ও চর্চা। কবি মুক্তচিন্তার শৈল্পিক উপস্থাপনের আকাঙ্খায় তাড়িত হন অহর্নিশ। যাপনের গ্লানিতে সমৃদ্ধ হয় পাল্টে দেয়ার শব্দচাষ। অনুসন্ধান করতে চান সময়হীনতার মাঝে ডুবে যাওয়া এ মৃত্তিকার ইতিহাস। নিজের সময়কে নিয়ে যেত চান বাকি সময়ের কাছে, বুঝতে চান গতির মন্ত্র। কবি আজাদুর রহমানের কবিতার ভাঁজে ভাঁজে যেন সে নির্দেশনারই স্পষ্ট রূপ দেখতে পাই।
ড. আজাদুর রহমান এর জন্ম বগুড়া জেলার অধীন সোনাতলা থানার গড়ফতেপুর গ্রাম। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে। পড়াশুনা শেষে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রজেক্টে গবেষক হিসেবে এক বছর কাজ করেন। বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশনেও বছর দুয়েক বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০১ সালে জাপান সরকারের মনোবুশো স্কলারশিপ পেয়ে সেখানে পড়তে যান। দেড়বছর পর পিএইচডি কোর্সের মাঝামাঝি হঠাৎই দেশে ফিরে নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন।
চাকুরিসূত্রে কুষ্টিয়ায় লালন একাডেমীর সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গভীরভাবে পরিচিত হন লালনের কীর্তিকর্মের সাথে। কাজের খাতিরেই বাউলদের সাথে কথা বলতে বলতেই আর গান শুনতে শুনতেই ‘লালন মত লালন পথ, সাধুর বাজার, লালনের গান-তিনটি বই লিখে ফেলেন। চাকুরীর খাতিরে বদলী। মেহেরপুর জেলায় মুজিবনগর উপজেলার ইউএনও থাকাকালীন স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান লন্ডনে। এবার টার্গেট উচ্চশিক্ষা, পিএইচডি। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী নিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরে চাকুরিতে যোগদান।
বর্তমান রাজবাড়ীতে উপ-সচিব পদ মর্যাদায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে ডিডিএলজি হিসেবে কর্মরত। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে গল্প, ফিচার, কবিতা এবং প্রবন্ধ লেখার পাশাপশি তিনি ফকির লালনের উপর গবেষণা করেন। তাঁর বিশ্বাস সত্য এবং সুন্দরের অনুসন্ধান করতে করতে মানুষ একদিন বেছে নেবে লালনের গান; বাচ্চারা পড়বে তাদের প্রথম পাঠ-‘সত্য বল, সুপথে চল; ওরে আমার মন।’ বইটি প্রকাশ করেছেন চৈতন্য প্রকাশনী, ঢাকা। দেশের অভিজাত লাইব্রেরিগুলোতে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম