আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার একটি গ্যারেজ থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি। ছবি: বহুমাত্রিক.কম
সাভার : যে বয়সে দূরন্তপনা-দুষ্টুমি ফাঁকে বই-খাতা-কলম নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে শিশুরা বেছে নিয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। নানা বাস্তবতায় শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মাধ্যমে জীবনকে করে তুলেছে দূর্বিষহ। এর মধ্যে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে হাত, পা বা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গহানি ঘটাচ্ছে। দুর্ঘটনায় ভাগ্যবশত যারা বেঁচে যায় তাদের পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে হয়।
ফলে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তেমনি ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। সারাদেশেই শিশু শ্রমের এমন চিত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এর অবস্থান যেন আশুলিয়ায় শীর্ষে!
বিভিন্ন তথ্য মতে, দেশের শিশুনীতি অনুযায়ী আঠারো বছরের নিচে যাদের বয়স তারা প্রত্যেকেই শিশু। এ বয়সে শ্রম নিষিদ্ধ। অথচ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় শিশুশ্রম দিনে দিনে উদ্বেগজনকহারে বেড়েই চলছে।
আঠারো বছরের নিচে শিশুশ্রম দন্ডনীয় অপরাধ হলেও আশুলিয়ায় ১০ বছরের নিচে বয়সের শিশুরাও নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়া পরিবারের অভাব অনটন আর সামাজিক নানা বাস্তবতার শিকার হয়ে বেশীর ভাগ শিশুরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে রোজগার করে জীবন চালায়।
এদিকে, মালিকপক্ষ শিশুদের পরিবারের অভাব অনটনের সুযোগ নিয়ে কম বেতনে তাদের কাজে লাগায়। এতে মালিকদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন হোটেল, চায়ের দোকান, ওয়ার্কসপ, বাস, লেগুনাসহ বিভিন্ন যানবাহনের হেলপার ও বিভিন্ন কারখানার কাজে উদ্বেগজনক হারে শিশুদের উপস্থিতি। তবে আইনে ১৮ বছরের কম বয়সীরাই হলো শিশু! সার্বক্ষণিক কর্মী, অসামাজিক বা অমর্যাদাকর ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা যাবে না।
শিশু আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী, কোন শিশুর কাছে উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নেশা হয়- এমন কোন পানীয় বা ওষুধ বিক্রি করা যাবে না। এমনকি যেসব স্থানে নেশাদ্রব্য বিক্রি হয়, সেখানে শিশুদের নিয়ে যাওয়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের শ্রম আইন (২০০৬) অনুসারে শ্রমিকের বয়স ১৪ বছরের নিচে হওয়া যাবে না। তবে চিত্র ভিন্ন। শ্রমে নিয়োজিত প্রায় শিশুর বয়স ১৪ পেরোয়নি।
শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলো বলেছে, দেশে ৮০ লাখের বেশি শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত। এদিকে, ২০১৩ সালের শ্রম জরিপে দেখা যায়, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ। শিশুশ্রম জরিপে দেখা যায়, ১৩ লাখ শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত।
আশুলিয়ার শিশুলিয়া ইউপির জিরানী বাজার-আমতলা সড়কে চলাচলরত অধিকাংশ লেগুনায় শিশুদেরকে হেলপারের কাজ করতে দেখা গেছে। এছাড়া শিমুলিয়া-আমতলা সড়ক, গোহাইলবাড়ী-রণস্থল সড়কে শিশুদেরকে বেটারি চালিতে অটো চালাতে দেখা গেছে। কিন্তু এসব শিশুরা জানেনা যে, যেকোন সময় ঘটতে পারে দূর্ঘটনা।
জিরানী বাজার-আমতলা সড়কে চলাচলরত যে কয়টি লেগুনা রয়েছে তা সম্পূর্ণ ফিটনেস বিহীন-নড়বড়ো। চলাচল করলে মনে হয় এই বুঝি ভেঙ্গে পড়ে গেল। এরপরেও স্থানীয় কোন প্রশাসন এসব যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি।
গত এক বছর আগে গোহাইল বাড়ী মেশিনপার এলাকার সফিকুল ইসলাম নামের এক শিশু বাসের হেলপারি করতে গিয়ে বাস থেকে পরে হাত ও পা ভেঙ্গে যায়। কি কারণে বাসে হেলপারি করার চাকরি নিয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে সফিকুল জানায়, তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় তার মা তাকে ও তার বড় দুই বোনকে নিয়ে নানার বাড়ী চলে আসে। সেখানে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করছিল সে। কিন্তু লেখাপড়ার খরচ যোগাতে না পেরে এক সময় সে চাকুরি নেয় চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়কে চলাচলরত একটি বাসে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই হঠাৎ একদিন বাস থেকে পরে গিয়ে তার একটি হাত ও পা ভেঙ্গে যায়।
সফিকুলের মত শত শত শিশু আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকাতে মিল কারখানায়, বাস, লেগুনা, গ্যারেজসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত। কিন্তু শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়লেও তারা নিজেরাও জানে না তাদের সুন্দর জীবনটা কঠিন পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ যে বয়সে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা, হাসি-খুশিতে পৃথিবীর আলোয় বেড়ে উঠার কথা আর সে বয়সে সংসারে দারিদ্র্যের চাঁপে পড়ে বেছে নিতে হচ্ছে কঠিন সংগ্রামের পথ। এতে করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের শিশু প্রতিবা ও আগামীর স্বপ্ন।
সেভ দ্য চিলড্রেন এর ডিপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর টিম হোয়েট সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে শিশুশ্রম নিরসনে ভালো কাজ করেছে। বাংলাদেশের এমন লাখ লাখ শিশু এখন স্কুলে যায়। এসব শিশুর জীবনমানের উন্নয়ন হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, এ দেশের ১৭ লাখ শিশু বিভিন্ন প্রকার কাজের সাথে যুক্ত। ডেনমার্ক আমার দেশ। ডেনমার্কের মোট স্কুলে যাওয়া শিশুর সংখ্যা ১৭ লাখের কম। আর বাংলাদেশে ১৭ লাখ শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
টিম হোয়েট বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারলে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসন হবে। শুধু সরকার একা কাজ করলে এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। সবার সাথে সমন্বিতভাবে শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করা প্রয়োজন।
ওই অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, মন্ত্রণালয়ের একটা হটলাইন থাকা উচিত। যাতে কোথাও শিশুশ্রম হতে দেখলে জানানো যায় এবং মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করলে ভবিষ্যতে দ্রুতগতিতে বাংলাদেশের শিশুশ্রম নিরসন হবে।
শিশুদের কাজের বিষয়ে ঢাকা-১৯ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ডাঃ এনামুর রহমান বলেন, শিশু শ্রম বন্ধ করতে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হওয়া দরকার। আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কি না, এটি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ আইন অনুসারে ১৪ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুরা কোন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না।
এছাড়া তাদের পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এগুলো মানা হয় না। মালিক ও শ্রম সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক নয়। শিশু শ্রম বন্ধে সরকারের কড়া নজরদারির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়ার প্রতি জোর দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বহুমাত্রিক.কম