Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

আলোকপাত : ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৪:২০, ৩ নভেম্বর ২০১৭

আপডেট: ১৪:২২, ৩ নভেম্বর ২০১৭

প্রিন্ট:

আলোকপাত : ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা

ছবি : সংগৃহীত

বিগত কয়েক বছর ধরে ‘জাতীয় মাছ’ ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করাতে বছর বছর গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু এ মাছটির পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়েই চলেছে-একথা জোর দিয়েই বলা যায়। তবে ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়ার সময় সম্পর্কে কথা উঠেছে। কেউ কেউ বলছেন বর্তমানে মৌসুমে ডিম ছাড়ার জন্য যে সময় দেওয়া হয় তা যথেষ্ট নয়।

সারাবিশ্বের মোট ৬০ ভাগেরও বেশি ইলিশ উৎপন্ন হয় আমাদের বাংলাদেশে। ঠিক সেজন্যই এবছরই (২০১৭) ইলিশকে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিশেষ আন্তর্জাতিক মর্যাদা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর-ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর পরে এখন শুধু বাংলাদেশের একটি পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে বিশ্বে যা বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন দেশ এর রপ্তানির তালিকায় দাবি করতে পারবে না।

কাজেই এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ স্বাদে-গন্ধে ইলিশ শুধু বাংলাদেশেরই নয় সারাবিশ্বের বিবেচনাতেও মাছের রাজার খ্যাতি অর্জনের যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে এ গুরুত্বপূর্ণ পণ্যটি কোন রকম নিয়ম না মেনে ছোট, মাঝারি, বড় সবভাবেই ধরে খাওয়ার কারণে এ সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছিল। তারপর থেকেই উদ্যোগ নেওয়া শুরু হলো কীভাবে এ মাছটির সংখ্যা, পরিমাণ ও উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বিভিন্নরকম বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত কৌশল প্রয়োগ করতে থাকেন।

যে নিষেধাজ্ঞা কিংবা অবরোধ ঢিলেঢালাভাবে চলছিল সেগুলোকে গতিশীল করা হয়। তারই অংশ হিসেবে বিগত বেশ কয়েকবছর থেকে একদিকে যেমন জাটকা নিধন অভিযান জোরদার করা হয়েছে অপরদিকে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জোরে সোরে করা হচ্ছে। তার সুফলও পাচ্ছে দেশবাসী। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে ২২ দিন পর যখন আবার ইলিশ ধরা শুরু হলো সেটা নিয়ে। দেখা গেছে অক্টোবর মাসে ২২ দিন ইলিশ মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকার পরে যখন পুনরায় ধরা শুরু হলো তখন সেখানে যে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে তার বেশিরভাগই আবার ডিমওয়ালা। প্রায় সবগুলো মাছেরই পেটভর্তি ডিম যা আমি নিজেও বাজার থেকে কিনে আনার সময় লক্ষ্য করেছি। এতে কথা উঠেছে যে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ রাখার পূর্বের সিদ্ধান্তে ২২ দিন সময় যথেষ্ট কিনা।

এ নিয়ে অবশ্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু সেসব আলোচনায় বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ মাছ তার পেটের ডিম সম্পূর্ণটা একবারে একধাপে ছাড়েনা। সেটি পরপর ছয়টি পূর্ণিমাতে একে একে ধাপে ধাপে ছেড়ে থাকে। তবে প্রথম পূর্ণিমাতে প্রথমবারেই নাকি সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। আর এতেই নাকি প্রচুর পরিমাণে ইলিশ উৎপাদন সম্ভব যা আমাদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এসব যুক্তিতে অনেকই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। সেজন্য দাবি উঠেছে এ নিষেধাজ্ঞার সময় ২২ দিন থেকে আরও বাড়ানো প্রয়োজন।



অপরদিকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ২ দিন মাছ ধরার পর আবার শুরু হয়েছে জাটকা নিধন বন্ধে নিষেধাজ্ঞার অভিযান। সেটি ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে চলবে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ এ দীর্ঘ সময় বড় ইলিশ ধরতে কোন বাধা নেই কিন্তু জাটকা ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষার্থে এ উদ্যোগটি অত্যন্ত কার্যকর ও প্রশংসনীয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এর বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে। এটি শুধু একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচারেই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন বিপুল তদারকি। আর সে তদারকি সঠিকভাবে করতে না পারলে পুরো উদ্যোগটিই ভেস্তে যাবে।

তবে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদো এ বিষেয়ে কোন আন্তরিকতার কোন অভাব দেখা যায় না। কারণ ইলিশ কিংবা জাটকা ধরতে না পারলে যেসব জেলেরা বেকার হয়ে পড়ে, সরকার তাদের জন্য ভর্তুকি হিসেবে ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে পূনর্বাসনের কর্মসূচি হতে নিয়েছে। চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালী, রাজশাহী ফরিদপুরসহ যেসব স্থানে ইলিশ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের কথা চিন্তা করতে হবে। তবে তাদেরকে ত্রাণের মাধ্যেমে পূনর্বাসনের কর্মসূচিটি শক্তিশালী ও কার্যকর রাখতে পারলে এর সুফল সবাই সমানভাবে পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর সেজন্যই ইলিশ মাছের চাহিদা অনুযায়ী এর উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক রাখতে হলে এর সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাই এর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ডিম পাড়ার সময় বৃদ্ধি করা এবং নিষেধাজ্ঞাগুলোতে কার্যকরা রাখার কোন বিকল্প নেই।

আর সবার আগে প্রয়োজন সর্বমহলে সচেতনতা। অন্যথায় কারো একার পক্ষে এ বিশাল জাতীয় কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা অসম্ভব। ডিমওয়াল মাছ ধরা, সরবরাহ, বিক্রি, ক্রয়, খাওয়া ইত্যাদি সচেতনভাবে সবাইকেই বন্ধ করতে হবে। অপরদিকে জাটকা নিধনসহ সকল কাজে সবাইকেই সমানভাবে সহযোগিতা করতে হবে। বাজারে অনেক সময় দেখা যায় চাপিলা মাছ বলে ছোট ইলিশের পোনা নামেমাত্র মূল্যে বিক্রয় করছে। এসব দেখামাত্র পুলিশে দেওয়া অথবা নিকটস্থ মৎস্য অফিস কিংবা আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের নজরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে আমাদের প্রিয় সুস্বাদু ও হারাতে বসা সদ্য জিআই হিসেবে স্বীকৃত ইলিশ মাছকে রক্ষা করতে হবে। আর আমরা নাগরিকরা সচেতন ও সোচ্চার হলে তা অবশ্যই সম্ভব। এতে হালে সবারই লাভ।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer