Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১০ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাষা নির্মাণ করেছেন সৈয়দ হক

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ২২:০৪, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আপডেট: ০০:২৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রিন্ট:

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাষা নির্মাণ করেছেন সৈয়দ হক

ছবি: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

ঢাকা : ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সমকাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ভীত রচনায় যে ক’জন লেখক অবদান রেখে গেছেন, তাদের অন্যতম ছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।

বিভিন্ন শ্রেণীপেশার বিজ্ঞজনেরা এ কথা জানিয়ে বলেছেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর বাংলা সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে তার মতো আর কারো বিচরণ ছিল না বলেই তাকে সব্যসাচী লেখক বলা হয়ে থাকে। তিনিই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাষা নির্মাণ করেছেন।

তারা বলেন, তিনি বাংলা সাহিত্যের শিক্ষকও বটে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার পামাপাশি তার লেখায় দেশের গণতন্ত্র আর সমাজব্যবস্থার কথা ফুটে উঠেছে।

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসে শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গণের প্রতিথযশা ব্যক্তিরা এভাবেই তাকে মূল্যায়ন করলেন।

নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও নজরুল গবেষক এমিরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে সমকাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের যে ভীত গড়ে উঠেছে, তার পেছনে ৪ জন সাহিত্যিকের অবদান সবচেয়ে বেশি। আর তাদের অন্যতম ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।

তিনি বলেন, সাহিত্যের ভিত রচনায় তার অন্য তিন সারথী হলেন- হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ ও কবি শামসুর রাহমান।

আবুল হাসনাত বলেন, সৈয়দ হক আধুনিক সাহিত্যের যে ভাষা নির্মাণ করে গেছেন, আগামীতে তা অবলম্বন করেই সাহিত্যের ভূবন তৈরি হবে। তিনি শুধু ভাষাই নির্মাণ করেননি, সেই সাথে কবিতার ধরণেও এনেছেন পরিবর্তন।

কালি ও কলম পত্রিকার এ সম্পাদক আরো বলেন, বিশ্বসাহিত্যের আধুনিকতম ধারায় তিনি স্বকীয় সব চরিত্র তৈরি করে গেছেন। শব্দ গঠন ও বাক্যরীতি নির্মাণে তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি আবেগবর্জিত ছিল না।

জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বরীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসু ও সৈয়দ হককে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক বলা চলে।

কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মুকসুদ বলেন, সৈয়দ শামসুল হক একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আলোকিত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার লেখায় ফুটে উঠেছে দেশের গণতন্ত্র আর সমাজব্যবস্থার কথা।

আবুল মকসুদ আরো বলেন, সব্যসাচী লেখক সব সময়ই মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালী ও বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করতেন। শত অসুস্থতার মধ্যেও তিনি তাদের ভুলেননি। শেষ সময়েও তাই তিনি শেখ হাসিনাকে নিয়েও গান লিখে গেছেন।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সব্যসাচী এ লেখক সময়ের অপচয় করেননি। সময়কে তিনি কাজে লাগিয়েছেন মানুষের চেতনাবোধ জাগ্রত করতে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সৈয়দ হক ছিলেন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার সাহিত্যকর্ম মানুষের কল্যাণে অবদান রাখবে। নতুন প্রজন্মেকে অনুপ্রাণিত করবে। তিনি

জনগণের মানুষ ছিলেন। গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ তার মানসপট।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল। তিনি লেখনীর মাধ্যমে গোটা দেশ ও জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। স্বৈরাচারকে হটানোর জন্য ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগাতে তিনি হাঁক দিয়েছিলেন- ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই...’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক আরও বলেন, দেশব্যাপী ‘জ্বালাও পোড়াও’ রাজনীতির বিরুদ্ধেও তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সব্যসাচী লেখকের সাহিত্যকর্ম সর্বস্তরে তথা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও তিনি অনুরোধ জানান।

১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, তার মৃত্যুতে পুরো জাতি ব্যথিত ও শোকার্ত চিত্তে তাকে স্মরণ করছে।

রামেন্দু মজুমদার বলেন, বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র সৈয়দ শামসুল হক তার লেখনী ও সৃজনশীল কর্মে অনন্তকাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।

মৃত্যু শয্যাতেও তার হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ ছিল উল্লেখ করে এ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, তাঁর স্বপ্ন ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ দেখে যাওয়ার। জীবদ্দশায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশে তিনি তা দেখে গেলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীর উৎসব তিনি দেখে যেতে পারলেন না, কিন্তু তার বড় সাধ ছিল এ দু’টি উৎসব দেখে যাওয়ার।

রামেন্দু মজুমদার আরো বলেন, অত্যন্ত বড় মাপের এ লেখক যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। তার সৃষ্টিসম্ভার যুগ যুগ ধরে বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করবে।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক সুবর্ণ জয়ন্তী দেখে যেতে পারেননি কিন্তু সুবর্ণ সময় দেখে গেছেন। তিনি যে দেশ দেখতে চেয়েছিলেন- তার সুবর্ণ সময় শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের সুবর্ণ সময় তিনি দেখে যেতে পেরেছেন। সৈয়দ হক তার জীবদ্দশায় দেখতে চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এটির শুরু তিনি দেখে গেলেন।

জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, লন্ডনে বসে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ এর চিত্রনাট্য দুটি তিনি জাদুঘরে দেবেন বলেছিলেন। আমরা ভাবছিলাম সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমানসহ গণ্যমান্যদের নিয়ে আমরা একটি সাহিত্য কর্ণার করবো। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন। আমরা অবশ্যই তার স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, স্বতন্ত্র ধারার সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন অনেক উঁচুতে। লন্ডনে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার আগে নিসার হোসেন তার আঁকা মোরগের একটি ছবি লেখককে উপহার দেন বলেও জানান।

শিল্পী হাশেম খান বলেন, সৈয়দ শামসুল হকের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ এক অসাম্প্রদায়িক মানুষ।

নাটক ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, জাতির প্রয়োজনে জাতির সামনে তিনি হাজির করেছিলেন নুরলদীন চরিত্রটিকে। সেই চরিত্রটি জাতিকে এক সাংস্কৃতিক দ্রোহের শক্তি জোগায়।”

পাশ্চাত্যরীতি থেকে ‘অনুপ্রাণিত’ হলেও লেখক সৈয়দ হক কখনও সেই রীতিতে ‘শাসিত’ হননি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বাংলা কাব্য সাহিত্যে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, আমার মনে হয় তার আশপাশে কেউ নেই। বাংলা ও বাঙালির অধিকার আদায় আন্দোলনের কথা তার প্রতিটি লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জঙ্গিবাদের কথা তিনি সাহিত্যে বলে গেছেন।

নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান বলেন, শিল্পীর মৃত্যু হয়, কিন্তু শিল্পের মৃত্যু হয় না। তাই মৃত্যুশয্যায় বসেও তিনি শেক্সসপিয়রের ‘হ্যামলেট’ অনুবাদ করেছেন। এ তো শুধু হক ভাইয়ের পক্ষেই সম্ভব।

তুমি বাঙালি কোথা থেকে এলে ? আমি এসেছি চর্যাপদ থেকে- বাঙালিকে তার গন্তব্য চেনানোর কাজটি সৈয়দ শামসুল হক করে গেছেন উল্লেখ করে কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, যে কারণে তিনি পাঠকদের লেখক, একইসঙ্গে তিনি ১৬ কোটি মানুষের পাঠক।

বাসস

 

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer