Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

আত্মহত্যা নয় আত্মবিশ্বাস

হাসান মাহমুদ রাজীব

প্রকাশিত: ১৪:১২, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

আত্মহত্যা নয় আত্মবিশ্বাস

ঢাকা : মানুষকে হতাশা ও নিরাশা থেকে বাঁচানোর অতি মূল্যবান উপাদান হলো বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেই নতুন কোনো আশা, ভরসা এবং বেঁচে থাকার প্রেরণা। বিশ্বাসের দ্বারা মানুষ প্রতারিত হয় এ কথা সত্য কিন্তু তারপরও জীবকুলে মানুষকেই শুধু বিশ্বাস করা যায়। আর জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এই বিশ্বাস অটুট থাকার জন্য প্রথমেই যে জিনিসটা প্রয়োজন তা হলো তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সঙ্গী এবং সহচর।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন ব্যক্তির অস্তিত্বের অনুভূতি ও তার সামাজিক মূল্যবোধের অনুভূতি নিবিড় হতে থাকে তেমনি সেখানে জন্ম নেই বিশ্বাসের। আর এই বিশ্বাস তার নিজস্ব গতিতে ধাবমান হতে হতে রূপ নেই তার স্বরূপ আত্মবিশ্বাসে। এই আত্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধেই ভিত্তিতে তার নৈতিক জীবন গড়ে ওঠে।

এরই সাথে নিজের আত্মপলব্ধির সচেতনতা অনুভব করে; তার পরিচিত ব্যক্তিবর্গ তাকে সেই সংশ্লিষ্ট বিশ্বাস, কর্ম ও আদর্শের সংযুক্তিতেই চিনে থাকে। সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত তার এই পরিচিতি তার সত্তাগত হয়। এই সত্তাতেই সে বেড়ে ওঠে। শুধু বেড়ে ওঠে বলব কেন, এই সত্তাতেই সে টিকে থাকার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে। ব্যক্তির এই নিজস্ব সত্তা প্রবাহিত হয় ব্যক্তিত্বে। এটাকে সে পরিচালিত করতে চায় সমাজ থেকে সমাজে, দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে মহাকালে। জন্ম থেকে জন্মান্তরে। আর এখানেই ব্যক্তির বেঁচে থাকার সার্থকতা।

এমনকি মৃত্যুর পরেও সে তার অনাগত সন্তানদের মাঝে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খোঁজে। অর্থাৎ সমাজে নানা ঘাত প্রতিঘাতে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারায় আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। তথাপিও তার অনাগত বীজ যেন তার ধারক ও বাহক হয়ে বেঁচে থাকে এ আশা সে সব হৃদয়ে লালন করে। সৃষ্টিকুলের সমস্ত প্রাণীই তা করে থাকে। আর তাই মৃত্যুর পূর্বে সে লিখে থাকে তার বীজটা যেন আগামী পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখে। যাতে সেখানে একসময় অঙ্কুরোদগম ও সবল সুকঠিন হয়ে ফুলে ফলে ফসলে তোলে পৃথিবী। এখানেও সেই আকুতি কাজ করে- মরিতে চাহি না সুন্দর ভূবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।

তারপরও সে তার উপস্থিত সত্তাকে বিসর্জন দেয়। কারণ প্রকৃতি এবং সমাজে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তার সেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ একসময় হার মানতে শুরু করে। সমাজের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হেয় প্রতিপন্ন মনোভাব তার হৃদয়-মন একসময় ব্যর্থতার গ্লানিতে ভরিয়ে দেয়। জীবনের চরম সফলতাও তখন ব্যক্তির কাছে ব্যর্থ বলে মনে হয়। সফলতা আর ব্যর্থতা মূলত এমন একটা জিনিস যে তা অনেক ক্ষেত্রে আপেক্ষিক বলেই মনে হয়। এই আপেক্ষিকতা যদি ভিষণ বিভিষিকার দিকে ধাবিত হয় তখন ব্যক্তি আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

সমাজে আমাদের যে বস্তুগত অস্তিত্ব তার মূলে রয়েছে আত্মা। আর এই আত্মাকে যখন নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে তাকে ভিষণরুপে পদদলিত করি যা কিনা ওই সমাজেরই তার কোনো পতিপক্ষ বা অন্য কোনো কারো ওপর করার কথা ছিল তখন শুধু নিজেই নিজের ধ্বংসের আত্মলীলাই মেতে উঠি। এটাও হয়তো বর্তমানের জঙ্গিবাদের বেশি দূরে নয়। আমরা শুধু সামাজিক গঠন-প্রকৃতিতে যে মানসিকতা ও সত্তাজাত পরিচিতি সেখানেই থাকতে চাই। কিন্তু মানব ব্যাপ্তি বোধ হয় তারও ঊর্ধ্বে।

‘আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস ১০ সেপ্টেম্বর। পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা ও প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয়, মাদক ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। বাংলাদেশে গত সাত বছরে ৭৩ হাজার ৩৮৯ জন আত্মহত্যা করেছেন। এদের বেশিরভাগেরই বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

‘আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের মাত্র একদিন আগেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলি বেছে নিলেন এই পথ। তার রুমে একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘সোয়াদকে (জলির ছেলে) যেনো ওর বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে।’ তিনি লিখেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম।’

শুক্রবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনের ৩০৩নং কক্ষ থেকে আকতার জাহানের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর ল্যাপটপের নিচে তার নিজ হাতে লেখা সুইসাইড নোটটি পাওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষক তানভির আহমদের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংসার করেন আকতার জাহান। ২০১২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত ওই আবাসিক ভবনে (জুবেরি) একাই থাকতেন জলি। তাদের সংসারে একটি ছেলে (সোয়াদ) রয়েছে। সে ঢাকায় নানিবাড়ি থেকে পড়াশোনা করে।

আসলে একাকিত্ব মানুষের মনকে এতটায় গভীরে নিয়ে যায় যে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ, বস্তুগত অবস্তুগতের বিভেদ সহজেই লোপ পায়। পাওয়া না পাওয়ার বোধটা তখন অনেক বেশি জাগ্রত হয়। সমাজের বিভিন্নতাকে এক কাতারে এনে দাঁড় করাতে মনে সদাসর্বদা আকুলি বিকুলি করে। আর এই ভাঙাগড়া সমানতালে চলে তার মানসপটে। একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দেয় সমস্ত দেহের কোষকলাগুলোয়। সমাজকে ভেঙে গড়ার এই যে স্পৃহা তখন স্বভাবতই নিজের ওপর বর্তায়। কিন্তু তারপরও কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না এই আত্মহনন।

আত্মহত্যার এই প্রবণতা আমাদের দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সমাজবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা জানান, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্রেম-বিরহ, বিচ্ছেদ এর কারণে মানুষ এক সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিত। সাধারণত মানুষিক সমস্যা, অত্যন্ত আবেগী চরিত্র ও জেদি প্রকৃতির মানুষেরা নানা ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যা করত। কিন্তু এখন ছোটখাট বিষয়ে মানুষ অত্মহত্যা করছে।বিশেষজ্ঞরা জানান, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন নড়বড়ে হওয়ার কারণে অত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। এখন সহজ প্রাপ্তির কারণে মানুষ ভোগবাদী হয়ে পড়েছে। সামান্য না পাওয়ার ঘটনা ঘটলে মানুষ রিঅ্যাকশন করছে। মানুষিক ভারসম্য হারাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে অব্যশই পারিবারিক বন্ধন মজবুত করতে হবে। মূলত মানুষ যখন একা হয়ে যায় তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু আত্মহত্যা যে সঠিক কাজ নয় এটা আত্মহত্যা প্রবণ মানুষের শেষ সময়ে বোধোদয় হলেও তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়।

আকতার জাহান জলির আত্মহত্যায় শোকে কাতর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন তাদের অভিমত। সবারই প্রশ্ন আকতার জাহানের মতো ব্যক্তিত্ব কীভাবে নিজেকে শেষ করতে পারেন। সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে পারেন না ফেরার দেশে।

জলির এক ছাত্র লিখেছেন, লাশকাটা ঘরে ফেলে এসেছি আপনার দেহ। কিন্তু ফেলতে পারিনি আপনার গভীর স্মৃতি। ম্যাম, আপনি প্রচণ্ড স্বার্থপর। হিম ঠাণ্ডায় কেমন করে ঘুমাচ্ছেন। আমরা ঘুমাতে পারছি না। আপনার স্মৃতিগুলো যন্ত্রণায় বিদ্ধ করছে। ম্যাম সবাইতো আপনাকে জানে না। ওরা কত কটুকথা বলবে। আপনার তো এটা প্রাপ্য ছিল না। আপনার মতো মানুষদের এভাবে যেতে হয় না। আপনি বোঝেন না? মায়ের অকাল মৃত্যুতে সন্তানদের অবস্থা কেমন হয়। তখন আমাদের কথা মনে হয়নি? একটুও মিস করেন নি? না জানি কত কষ্ট পেয়ে আমাদের কথা ভুলে চলে যেতে বাধ্য হলেন। ভাবতে পারছি না।

রফিকুল ইসলাম নামে একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আর পারছি না। ম্যাম আমাদের রিপোর্টিং পড়াতেন। শিখিয়েছেন কীভাবে কারো মৃত্যু সংবাদ লিখতে হয়। আজ তারই মৃত্যু নিয়ে লিখতে হচ্ছে। লিখতে হচ্ছে তার কক্ষে পাওয়া সুইসাইড নোট নিয়ে। না না। এ সত্য নয়। দুঃস্বপ্ন দেখছি। প্লিজ কেউ বলেন সত্য নয়, স্বপ্ন দেখছি।’

তার কথামতো আসলে যদি এটা স্বপ্ন হতো। তাহলে বোধহয় যথেষ্ট খুশির বিষয় ছিল। কিন্তু এরকম অজস্র স্বপ্ন প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে সত্যি হয়ে যাচ্ছে। আমরা আসলে এ ধরনের কোনো স্বপ্নও দেখতে চাই না। এমন কোনো স্বপ্ন নয় যেখানে হৃদয়ের সমস্ত অণু পরমাণু লোনা জলের কষ্টের ধারা অবিরল বইতে থাকবে।

আমাদের স্বপ্নে মৃত্যু নয় জীবন আসুক। আরো অনেক জীবন যাতে সুখ স্বপ্নকে লালন করে জন্ম জন্মান্তর আমাদের সত্তাকে প্রচণ্ডভাবে গ্রথিত করে। অনাগত ভবিষ্যতেও যাতে টিকে তাকে মানবীয় আত্মা এ ধরিত্রীর বুকে।

লেখক : সাংবাদিক

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer