তন্ত্রমুক্ত গণতন্ত্রের জন্য
মাথার উপর কাক
ক্রমাগত অলুক্ষণে ডাক
দিচ্ছিল।
কলের নালায় বসে
ঝুনা নারকেল খোসা আর ঝামা দিয়ে ঘঁষে
একজন পৌঢ়াজননী এঁটো থালাবাটি ধুয়ে
নিচ্ছিল।
সহপাঠীদের সাথে
ছেলে তার চলে গেছে রাজপথে
সকালে।
বাড়াভাত না খেয়ে
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তরিঘরি হাত ধুয়ে
যোগ দিতে স্বৈরাচারি শাসকবিরোধী
মিছিলে।
কুকুরটা বারবার
থেকে থেকে করছিল সকরুণ ডুৎকার
অঙ্গনে।
গণতন্ত্রকে তন্ত্রমুক্ত করবে বলে
মিছিলে গিয়েছিল চনমনে দুরন্ত ছেলে
ফিরে এল লাশ হয়ে মায়ের চোখে জল ঝরাতে
নির্জনে।
শান্তির সন্ধানে
একদিন শ্রাবণের দুপুরে ঝরোঝর
বৃষ্টি। ট্রেনে চেপে নিরুদ্দেশ গরোগর
ছুটেছি শান্তির সন্ধানে। অফিস-আদালত
হাঁপিয়ে তুলেছে অন্তর, ইট-পাথরের বলবৎ
বলয় ডিঙিয়ে চাই স্তব্ধতার সমাধি।
আকাশ বিরামহীন বৃষ্টির ধূসর জলধি-
হঠাৎ ট্রেন গেল থেমে, অচেনা স্টেশন।
জানালার পাশে বসা আমি অনুক্ষণ
তাকালাম নিকটবর্তী জনময় প্ল্যাটফর্মে
আচমকা চঞ্চল দৃষ্টি গেল থেমে
তিনটি নিগৃহীত মানুষের মাঝে। তখনকার
প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ঘিচঘিচ। একটি ছাতার
নিচে তিনটি প্রাণী, পেশাতে ভিক্ষুক
প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে একটু দূর-এক পরিবারের লোক
বোধহয়; স্বামী-স্ত্রী-সন্তান। লোকটার
একটা পা উরু বরাবর কাটা, বিকলাঙ্গ। লাঠিতে ভর
বাম হাতে, আর ডান হাতে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে
ভিক্ষের থালা ধরে। পাশে তার সঙ্গিনী হাত বাড়িয়ে
ধরে আছে সে ও সেই থালাটিতে। একখানা পুরাতন
সিলবারের বিবর্ণ থালা তাদের উপার্জন
করার পন্থা। ললনার বাম কোলে
একটা উলঙ্গ শিশু, সুদৃপ্ত হাত তুলে
সচ্ছিদ্র প্রাচীন ছাতাটা রেখেছে ধরে
মা বাবার মাথার উপর। টিপ টিপ পানি ঝরে
তাদের শরীরে-ছিদ্র ছাতা, গায়ের কাপড়
শতছিদ্র, যেন মাছ ধরার জাল। থালার উপর
ট্রোক করে একটা পয়সা ফেলে দিলাম
অমনি কি লাফিঝাফি শিশুটার, এক ছিলিম
তৃপ্তির উৎকণ্ঠা দম্পত্তির চোখে মুখে।
ওরা নিশ্চয়ই আছে ভীষণ সুখে, ভীষণ সুখে-
এক থালা দিয়ে ভিক্ষে করে। পুরুষের ডান হাত
আর নারীটির শুকনো জীর্ণ বাম হাত
ধরা থাকে একটি বাসনে-যে বাসন
তাদের চির দিবসের উপজীব্য। তখন
মনে হয় ওরা তিনটি নয়, একটি প্রাণী
দুই হাতে একটি বাসন ধরে টানাটানি
করছে একটি প্রাণী। একটা ছাতার তলে
একটা সংসার-স্বামী স্ত্রী সন্তান কোলে
দাঁড়িয়ে ভিক্ষের থালা হাতে, মুখে হাসি
অফুরন্ত তৃপ্তির। ওদের সংসারে রাশি রাশি
শান্তির ভিড়, অথচ সংসার আছে আমারও
স্ত্রী সন্তান আছে এই অভাগা আমারও ।
এক ঘরে এক ইটের ছাদের নিচে এমন কি
এক বিছানায় থাকি, তবু হৃদয়-চক্ষে দেখি
অদ্ভুত অদৃশ্য দেয়াল বিদ্যমান আমাদের মাঝে।
এখানে কেবল দুঃখের সানাই বাজে
সুখের সাক্ষাৎ নেই এ সংসারে। অর্থ ভাণ্ডার
সন্তান সম্পত্তি, সুন্দরী স্ত্রী কী নেই আমার?
নেই কেবল এক টুকরো শান্তি যা আছে
ঐ ছিদ্র ছাতার নিচে ফকিরের ঘরে, নেই আমার কাছে।
চাই না এ অট্টালিকা, ইট-পাথর অর্থ-ভা-ার রাশি
চাই শুধু একখ- শান্তি, দু’দ- তৃপ্তির হাসি-
যে হাসি হাসতে পারে ঐ ল্যাংড়া ভিক্ষুক, পারি না আমি
যে হাসি অমূল্য অমৃত, স্বর্গসম দামী।
বহুমাত্রিক.কম