Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

অকুতোভয় মা’য়ের নব্বই ও স্মৃতিপটে একাত্তরের সেই দিনগুলি

রুহেল আহমেদ বাবু

প্রকাশিত: ০১:০৪, ১ জানুয়ারি ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

অকুতোভয় মা’য়ের নব্বই ও স্মৃতিপটে একাত্তরের সেই দিনগুলি

ছবি : লেখক

পৃথিবীর কত অসংখ্য মানুষের মা বেঁচে নেই, জন্মদাত্রী-সবচেয়ে আপনজনকে হারিয়ে আজ প্রাণের ভেতরে ভয়ংকর এক শূন্যতা আর আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে আছে তারা।কত মানুষ জন্মাবার সময়েই তার মাকে হারিয়ে ফেলে, কত মানূষ মাকে হারিয়ে ফেলে শৈশবে, কৈশোরে, তরুণ বয়সে, কত অসংখ্য মানুষ মাকে হারিয়ে ফেলে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত আসার ঠিক আগে। জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহুর্তে তার বুকের ভেতর মা হারানোর কষ্ট আর যন্ত্রণা ব্যাথার মত বাজে। আফসোস করে তারা, ইশ! আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন! কত খুশিই না হতেন সন্তানের এই সাফল্য দেখে, আনন্দ দেখে! মা’কে আরেকটাবার দেখার জন্য, আরেকবার মায়ের বুকে আশ্রয় পাবার জন্য কি আকুল প্রতীক্ষায় থাকে পৃথিবীর কত মানুষ!

আজ এতো বছর পর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, কি অসম্ভব সৌভাগ্যবান আমি, আমার মা বেঁচে আছেন। আমার মা ভালো আছেন। আমার মা আমার পাশেই আছেন। চাইলেই আমার মাকে ছুতে পারছি, তার স্নেহমাখা ভালোবাসার পরশ পাচ্ছি। জীবনের একটা বিশাল সময় আমি আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে ছিলাম। নানা কারণে, ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় সময় দিতে পারিনি তাকে, বিদেশে ছিলাম অনেকদিন, দেশে ফিরেও সেভাবে মায়ের কাছে থাকা হয়নি। পৃথিবীর কত মানুষ মায়ের অভাবে কাঁদে, অথচ আমি দুর্ভাগা মা’কে এতো কাছে পেয়েও তার কাছে থাকতে পারিনি, তাকে রাখতে পারিনি।একই শহরে থেকেও ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় মা আর আমি দুজন দুপ্রান্তে থেকেছি, মাঝে মাঝে দেখা হত, কিন্তু থাকা হত না। আজ আমার মায়ের ৯০তম জন্ম বার্ষিকীতে আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের মুহুর্ত! কারণ এখন থেকে আমি আর আমার মা এক সাথে থাকবো, এখন থেকে আমার মা আমার সাথে থাকবেন! তিনি আমার সাথে থাকতে চেয়েছেন, আমাকে তার কাছে রাখতে চেয়েছেন। এ যে আমার জন্য কত আনন্দের, বলে বোঝানো যাবে না। চাইলেই মায়ের পাশে গিয়ে বসে থাকতে পারবো, মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিতে পারবো, মায়ের সাথে গল্প করতে পারবো, মা আমাকে আদর করতে পারবেন,আর আমি প্রান ভরে মাকে বুকে চেনে নিতে পারবো। বছরের প্রথমদিনে আজ আমার মায়ের জন্মদিনে এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কিছু নেই আমার কাছে!

আমাদের ধানমন্ডির বাড়িটা একাত্তরের নয় মাস ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সেইফহাউজ। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এখানে আশ্রয় নিয়েছে, ভয়ার্ত অসংখ্য মানুষকে আমার মা একাত্তরের পুরো সময়টা পরম স্নেহে আশ্রয় দিয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে তাঁকে মেরে ফেলতে পারতো এই অপরাধে, সে কখনো ভয় পায়নি।
সেই ছোটবেলা কেন যেন আমার মাকে কক্ষনো ভয় পেতে দেখিনি। একাত্তরের ২৫শে মার্চ রাতে যখন ক্র্যাক ডাউন হল, মানুষ ছুটছে দিগ্বিদিক, হতবিহ্বল, স্রেফ প্রাণটা বাঁচানোর তাগিদে, তখন বাসায় ফিরে দেখি সবাইকে আগলে রেখে আমাদের বাড়ীর করিডরে বসে আছেন আমাদের মা। সেই যে শুরু হল সবাইকে আগলে রাখা, এরপর নয়টা মাস মানুষের সেই স্রোত আর থামেনি। সেটা দেখার জন্য আমি অবশ্য বাড়ি ছিলাম না, কারফিউ উঠে যেতেই আমাকে,ছোট ভাই সোহেল,বন্ধু সেলিম, বন্ধু বাচ্চুকে মার অমোঘ নির্দেশ, দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরবি না, দেশটা স্বাধীন করতে হবে, ডাক আসছে, যুদ্ধে যাও!"

দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরে কি অপরিমেয় ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেই না এনেছিল আমাকে এই পৃথিবীতে, দেশমাতার বিপদে স্নেহের সেই অচ্ছেদ্য বন্ধনটারও পরোয়া করেনি। বুকে দশমন পাঁথর বেঁধে কি অবলিলায় কড়া চোখে তাকিয়ে বলেছিল, দেশটা স্বাধীন না করে ঘোরে ফিরবি না...আজ এতদিন পর সেই অদ্ভুত ভয়ের সময়টার কথা মনে হলে বড্ড অবাক লাগে। মাতৃহৃদয়ের সীমাহীন অপত্যস্নেহের উর্ধে উঠার এমন অমিত সাহস মানুষটা পেল কোথায়।

আকাশে চিল আসলে একটা মুরগী যেমন তার কচি বাচ্চাগুলোকে পাখার আড়ালে লুকিয়ে রাখে, সেইভাবে আমার মা মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রেখেছিল। শুধু তাই নয়, সাহাবাবুর পুরো পরিবারকে, গপেশ মালাকের স্ত্রী-পুত্র-সন্তানদের পরিবারগুলোকে একাত্তরের নয়টা মাস লুকিয়ে রেখেছিল যক্ষের ধনের মত।  নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর গেরিলা দলটার নির্ভরযোগ্য হাইডআউট ছিল এ আমার মায়ের বাসা। সেই মায়ের নব্বই বছর বয়স হলো আজ!

পৃথিবীর কত অসংখ্য মানুষের মা বেঁচে নেই, জন্মদাত্রী-সবচেয়ে আপনজনকে হারিয়ে আজ প্রাণের ভেতরে ভয়ংকর এক শূন্যতা আর আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে আছে তারা।কত মানুষ জন্মাবার সময়েই তার মাকে হারিয়ে ফেলে, কত মানূষ মাকে হারিয়ে ফেলে শৈশবে, কৈশোরে, তরুণ বয়সে, কত অসংখ্য মানুষ মাকে হারিয়ে ফেলে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত আসার ঠিক আগে। জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহুর্তে তার বুকের ভেতর মা হারানোর কষ্ট আর যন্ত্রণা ব্যাথার মত বাজে। আফসোস করে তারা, ইশ! আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন! কত খুশিই না হতেন সন্তানের এই সাফল্য দেখে, আনন্দ দেখে! মা’কে আরেকটাবার দেখার জন্য, আরেকবার মায়ের বুকে আশ্রয় পাবার জন্য কি আকুল প্রতীক্ষায় থাকে পৃথিবীর কত মানুষ!

আজ এতো বছর পর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, কি অসম্ভব সৌভাগ্যবান আমি, আমার মা বেঁচে আছেন। আমার মা ভালো আছেন। আমার মা আমার পাশেই আছেন। চাইলেই আমার মাকে ছুতে পারছি, তার স্নেহমাখা ভালোবাসার পরশ পাচ্ছি। জীবনের একটা বিশাল সময় আমি আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে ছিলাম। নানা কারণে, ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় সময় দিতে পারিনি তাকে, বিদেশে ছিলাম অনেকদিন, দেশে ফিরেও সেভাবে মায়ের কাছে থাকা হয়নি। পৃথিবীর কত মানুষ মায়ের অভাবে কাঁদে, অথচ আমি দুর্ভাগা মা’কে এতো কাছে পেয়েও তার কাছে থাকতে পারিনি, তাকে রাখতে পারিনি।একই শহরে থেকেও ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় মা আর আমি দুজন দুপ্রান্তে থেকেছি, মাঝে মাঝে দেখা হত, কিন্তু থাকা হত না। আজ আমার মায়ের ৯০তম জন্ম বার্ষিকীতে আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের মুহুর্ত! কারণ এখন থেকে আমার মা’কে আমার কাছে এনে রাখবো।

আমাদের ধানমন্ডির বাড়িটা একাত্তরের নয় মাস ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সেইফহাউজ। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এখানে আশ্রয় নিয়েছে, ভয়ার্ত অসংখ্য মানুষকে আমার মা একাত্তরের পুরো সময়টা পরম স্নেহে আশ্রয় দিয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে তাঁকে মেরে ফেলতে পারতো এই অপরাধে, সে কখনো ভয় পায়নি। ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাইডআউট ছিল বাসাটা ,পাকিস্তানি সেনাদের নিরন্তর টহলের মাঝেই ওরা রাতের বেলা অস্ত্র-গোলাবারুদ এনে তুলতো,হিসেবে একচুল এদিকওদিক হবার উপায় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিন এখানেই থেকেছে কত্তদিন। নির্ভরতার প্রতীক হয়ে অসমসাহসী মা আমার সব সামলেছে। দীর্ঘ এই সময়টার যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানি আর্মি আমাদের বাড়িতে রেইড করতে পারতো, (একবার এসেও ছিল) মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেবার অপরাধে হয়তো মুহূর্তের মাঝে একরাশ বুলেটের ব্রাশফায়ার স্তব্ধ করে দিতে পারতো তাঁকে, অকুতোভয় মা আমার এক মুহূর্তের জন্যও ভয় পায়নি... এক মুহূর্তের জন্যও না

আজ ৪৭ বছর পর দুর্ভাগ্যক্রমে চাঁদ-তারায় মোড়া স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানী শকুনের দল আজো লাল-সবুজে রাঙা এই স্বাধীন জমিনটা সহ্য করতে পারে না। মহাকালের কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নেয়া হিসেবের সামনে দাঁড়াতে অসম্ভব ভয় পায় শকুনগুলো। বাজে বকে অহরহ। শকুনগুলো ভুলে যায়, একাত্তরে আমার মায়ের মত এরকম হাজার হাজার পাথরকঠিন মায়েরা ছিল বলেই ওদের নাকে খত দিতে হয়েছিল, আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। শকুনগুলো ভুলে যায় এই স্বাধীন বাংলাদেশের যতদিন থাকবে, ততদিন আমার মায়ের মত মানুষগুলো বিজয়ের লাল সূর্যটা সাথে নিয়ে ওদের দুঃস্বপ্নে ফিরে আসবে... ফিরে আসবে আলতাফ মাহমুদ, ফিরে আসবে ডাঃ আবদুল আলীম চৌধুরী,ফিরে আসবে শহীদুল্লাহ কায়সার, ফিরে আসবে মুনির চৌধুরীরা... বারবার... আঙ্গুলটা তুলে বলবে, তোরা হেরে গেছিস, চিরকালের মত... এই অকুতোভয় মানুষগুলো যে কখনো হারতে জানে না...

শুভ জন্মদিন মা... জরা আর বয়সের বাঁধা অতিক্রম করে তুমি আরও অনেকদিন অনেকদিন বেঁচে থাকো, ভালো থাকো, আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে, ভালোবাসায়! লাল-সবুজ যে পতাকাটা ছিনিয়ে এনেছিলাম তোমার জন্য, সেটা ফেলে কখনো যেতে পারবে না কিন্তু, মনে থাকবে তো? কথা দাও মা!

লেখক : একাত্তরের রাণাঙ্গনের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer