Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

সৌন্দর্য আর সম্ভাবনার আধার হাওর

আনজুমান আরা শিল্পী

প্রকাশিত: ১৫:৫৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪

আপডেট: ১৪:১৮, ২ অক্টোবর ২০১৪

প্রিন্ট:

সৌন্দর্য আর সম্ভাবনার আধার হাওর

হাওর অঞ্চল ঘুরে এসে: হাওর-বাওর ও সমতলভূমির বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির একটি বিস্তীর্ণ জনপদ কিশোরগঞ্জ। এজন্য একে বলা হয় ‘ভাটির দেশ’। জেলার সর্বত্র যেন সবুজ শ্যামলিমায় আচ্ছন্ন। বর্ষাকালে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ নিন্মাঞ্চলে ‘হাওরের’ সৃষ্টি হয়। বর্ষাকালে হাওরের সৌন্দর্য অপরূপ রূপ ধারণ করে।

শুকনো মৌসুমে যেখানে ধু-ধু প্রান্তও, বর্ষায় তা সমুদ্রসম রূপ ধারণ করে। যতদূর চোখ যায়, শুধুই অথৈ জলরাশি। ছোট-বড় ঢেউ গর্জন করে আছড়ে পড়ে তীরে। দূর থেকে ছোট ছোট গ্রামগুলোকে দ্বীপের মতো মনে হয়। মনে হয় যেন হাওরের পানিতে ঢেউয়ের দোলায় ভাসছে সেসব গ্রাম। এ সময় হাওরে চলাচল করে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা।

রঙিন পাল তোলা নৌকাও দেখা যায়। জাহাজ আকৃতির মালামাল পরিবহনকারী বড় বড় কার্গোও সদা চোখে পড়বে। দাঁড় বেয়ে চলা নৌকা ও মাঝিদের কণ্ঠের সুরেলা গানও শোনা যায়। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে জেলেদের জাল দিয়ে মাছ ধরা তো নিত্যদিনকার চিত্র।

ভৈরব-কুলিয়ারচর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও কালনী নদীর মোহনায় জোয়ারের পানির সঙ্গে ভাটি অঞ্চল নেত্রকোনার সুমেশ্বরী, কংস, মগড়া, ধনু, ঘোড়াউৎরা ও সুরমা-কুশিয়ারার পানির সঙ্গম ঘটে। এই জলসঙ্গমে প্রকৃতি তিন মাস লীলা করে।

‘হাওর’ কোনো স্থায়ী জলাশয় বা জলাধার নয়। বর্ষায় যেখানে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। শুষ্ক মৌসুমে সেখানেই মাইলের পর মাইল চোখ জোড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও, এইডাই উজান-বাডির বাও’।

বর্ষাকালে বাংলাদেশে ভ্রমণের উত্তম জায়গা হাওর। হাওর ভ্রমণে লাভ শুধু আনন্দেই নয়; এতে শিকড়েরও সন্ধান মিলে। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে ‘হাওর’ অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। হাওর অঞ্চলের মানুষের দেখা ‘হাওর’ আর বাইরের লোকের ধারণায় ‘হাওর’ এক নয়। ‘হাওর’ হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গমস্থল।

হাওরের পরিধি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যাঅনুযায়ী, ৮০ লাখ হেক্টর ভূমিতে হাওরের অবস্থান। আবার অনেকে বলেন, তার চেয়েও বেশি। মতান্তরে কোটি হেক্টর ভূমিতে হাওর বিস্তৃত। এর মধ্যে বড় ৬টি এবং ছোট ও মাঝারি অংখ্য হাওর ও নদী-নালার সমন্বয়ে এই জলাধার।

রাজধানী ঢাকা থেকে বেশি দূরে নয় হাওর। মাত্র ঘণ্টা চারেকের পথ। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি এলাকা দিয়ে হাওরে যাওয়া যায়। বর্ষায় হাওরে বেড়ানো মানেই যেন সাগরসঙ্গম। ১০-১২ জন মিলে তিন থেকে সাত দিনের জন্য হাওরে বেড়াতে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়।

হাওরবাসীর জীবন চিত্র

নানা সমস্যায় জর্জরিত এসব হাওরবাসীর জীবনের চিত্র দেখে যে কারও মনে রেখাপাত করবে। চামড়া বন্দরে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকালেই এসব চিত্র চোখে পড়ে। দৃষ্টিসীমার একেবারে কিনারে বক্ররেখার মতো কালো আঁকা-বাঁকা, ছড়ানো-ছিটানো অগোছালো গ্রামগুলো দূর থেকে দেখলে মনে হয় অথৈ সাগরের মাঝে কি যেন ভেলার ওপর ভাসছে।

বাস্তবিক অর্থে তাদের জীবনটা ভাসমান ভেলার মতোই নড়বড়ে। প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে তাদের টিকে থাকতে হয় হদয়হীন এই পৃথিবীতে। বর্ষাকালে বাড়ির চারপাশে তৈরি করতে হয় আড়া (বাঁশের বেড়া)। এর ভেতর খড়কুটা, কচুরিপানা ভরে স্পঞ্জের মতো করা হয়। যার মাধ্যমে দানব আকৃতির ঢেউ থেকে নিজেদের রক্ষা করে হাওরবাসী। আর বর্ষা মৌসুমে পর্যটকরা এসব এলাকায় ভিড় জমান বিনোদনের জন্য।

কোন পথে যাবেন

ঢাকা থেকে ভৈরব, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর ও চামড়া বন্দর দিয়ে হাওরে যাওয়া যায়। প্রতিটি পয়েন্টেই রয়েছে সুন্দর সুন্দর নৌকা ও ট্রলার। এসব ট্রলারে রাতে ঘুমানোরও ব্যবস্থা রয়েছে। হাওরের হরেক রকমের সুস্বাদু মাছ দিয়ে তিন বেলা খাবারের আয়োজন এই ভ্রমণকে আনন্দময় করবে। ট্রলার মালিককে আয়োজন করতে বললেই হবে।

চামড়া বন্দর দিয়ে হাওরে যেতে চাইলে ঢাকার মহাখালি থেকে উজান-ভাটি পরিবহনে সোজা চামড়া বন্দরে গিয়ে নামতে পারেন। বন্দর ঘাটেই ট্রলার পাবেন। সকাল সাতটায় ঢাকা থেকে রওনা দিলে সাড়ে ১০টায় চামড়া বন্দর ঘাটে পৌঁছে যাওয়া যাবে। ঘাটে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো তাজা মাছ কিনে নিয়ে ট্রলারে উঠে পড়–ন।

ভৈরব, বাজিতপুর কিংবা কুলিয়ারচর দিয়ে গেলে নরসিংদী এলাকার পথের বাজারগুলো থেকে টাটকা সবজি নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া আপনি যে পথেই যাবেন, সকালে সবখানেই টাটকা সবজি পাবেন। ট্রলার বুকিং দেয়ার সময় বলতে হবে রান্নার উপকরণ রাখার জন্য। হাওর এলাকার প্রতিটি ঘাটেই সকালে তাজা মাছ পাবেন। ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রোড়ের যে কোন বাসে কিংবা ট্রেনে ভৈরব, বাজিতপুর এবং কুলিয়ারচর যাওয়া যাবে। এছাড়াও হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ দিয়ে হাওরে যাওয়া যায়।

ট্রলার বুকিং

হাওরে ঘুরে বেড়ানোর উপযোগী বড় ট্রলারগুলোর ভাড়া নেবে প্রতিদিন ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা। তেল যা লাগে আপনি দেবেন। রাতে ট্রলারে ঘুমাতে না চাইলে হাওর এলাকার অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা, খালিয়াজুরি, নিকলী, মদন, মোহনগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, তাহিরপুর প্রভৃতি উপজেলায় ডাকবাংলো আছে। সেগুলোতেও থাকতে পারবেন। ডাকবাংলোর কন্টাক্ট করার ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। হাওরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে যদিও এখনো সরকারিভাবে পর্যটনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তবু ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাওর ভ্রমণ কম আনন্দের নয়।

নিকলী ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনা

হাওর-বাঁওড়সমৃদ্ধ কিশোরগঞ্জ জেলার একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিকলী উপজেলা। জেলা সদর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই নিকলীতে রয়েছে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা। নিকলীর হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র।nikli

নিকলী উপজেলা সদরকে রক্ষার জন্য রয়েছে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ। বর্ষাকালে এই বাঁধে চারিদিক থেকে সমুদ্রের মতো ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। এই বেড়িবাঁধেই দাঁড়িয়ে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বাঁধজুড়ে রয়েছে অসংখ্য গাছপালা। সারাক্ষণ পাখিদের কিচির-মিচির শব্দ।

শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। সাঁঝের বেলায় মুক্তোর মালার মতো সেসব বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার সময় মুখরিত কলকাকলির কান ফাটানো শব্দ একমাত্র হাওর এলাকাতেই শোনা সম্ভব। এছাড়া এ উপজেলায় রয়েছে অনেক পুরাকীর্তি।

স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বেড়িবাঁধের পাশে বসার জন্য কিছু সংখ্যক বেঞ্চ ইতিমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। নিকলী উপজেলা পরিষদ বিল্ডিংয়ের ঠিক সামনেই আরসিসি পিলারের ওপর ‘বর্ষাবিলাস’ নামে একটি অবসর কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রতিবছরই বর্ষা শুরু হলে জেলা ও জেলার বাইরে থেকেও প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নিকলী উপজেলা সদরে আসে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন গণ-সাংস্কৃতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খায়রুল আলম বাদল জানান, বর্ষায় সমুদ্র উপকূল উত্তপ্ত এবং সাগর উত্তাল থাকায় পর্যটকরা বর্ষা মৌসুমে বেড়ানোর জন্য বিকল্প স্থান হিসেবে বেছে নিতে পারেন নিকলী উপজেলা সদরকে।

সাংবাদিকদের হাওর ভ্রমণ

haorসম্প্রতি বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংবাদিক সমিতি-ঢাকা ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ সেপ্টেম্বর ‘উজান-ভাটির হাওর উৎসব’ করেছে। ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও স্যাটেলাইট মিডিয়ায় কর্মরত দেশের বিভিন্ন জেলার ৩০ জন সাংবাদিক প্রত্যেকে চাঁদা দিয়ে এই ভ্রমণে অংশ নেন।

এদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক নেতা মোল্লা জালাল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দৈনিক পূর্বকোণ ও ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি কুদ্দুস আফ্রাদ, মাছরাঙা টেলিভিশনের মুতাসিম বিল্লাহ, নয়া দিগন্তের আশরাফ আলী, প্রথম আলোর বিকাশ চন্দ্র দাস ও আব্দুল মান্নান, দিনকালের আব্দুস সেলিম, আইএনবির রাজেন্দ্র চন্দ্র দেব মন্টু, সমকালের খায়রুল আলম।

আরো ছিলেন ডেইলি অবজারভাবের ফারুক আহমেদ তালুকদার ও অমিয় ঘটক পুলক, কালের কণ্ঠের গোলাম কিবরিয়া, তারকালোক সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল খোকন, নবযুগ ও সিনেকণ্ঠ সম্পাদক এরফানুল হক নাহিদ, বৈশাখী টিভির শাহনাজ পারভীন এলিস, গান বাংলা টিভির দুলাল খান, সময় টিভির রফিক সাদি, বাংলাদেশ সময়ের আনজুমান আরা শিল্পী, যমুনা নিউজ ২৪ডটকমের নাজু মির্জা, দ্য রিপোর্ট ২৪ ডটকমের বাহরাম খান, সংবাদ প্রতিদিনের ইকবাল হাসান কাজল ও এনএনবির এসএম হানিফ।

বাজিতপুর থেকে শুরু

সাংবাদিকদের হাওর যাত্রা শুরু হয় বাজিতপুর থেকে। বাজিপুরের হুমাইপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সফিউল হক সাংবাদিকদের স্বাগত জানিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেন। তিনি বিভিন্ন পদের সুস্বাদু মাছসহ রাজহাঁসের মাংস ও দই দিয়ে অতিথিদের ভুরিভোজ করান। হুমাইপুরের স্থানীয় লোকজন তাদের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হাই স্কুলটির এখনো একাডেমিক ভবন না হওয়ার দুঃখের কথা জানান। তারা এ বিষয়ে সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

খালিয়াজুরির পথে

হুমাইপুর থেকে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে খালিয়াজুরির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। এসময় পরন্ত বিকেলে সূর্যরশ্মির আগুন যেন হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে যাত্রীবাহি ট্রলারগুলোর ছুটে চলা। মনে হয় সবাই যেন প্রাণপণে ছুটছে অন্ধকারের আগেই ঘরে ফিরতে। সন্ধ্যে সাতটায় অষ্টগ্রামের বাহাদুরপুরে সল্প সময়ের যাত্রা বিরতি ঘটে। এখানে তারকোলোক সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল খোকন তার পিতা নজরুল ইসলামের নামে একটি পাঠাগার শুরু করেছেন। সাংবাদিক নেতাদের দিয়ে তিনি পাঠাগারের উদ্বোধনী ফিতা কাটান। এখানেও কয়েকশ’ লোকের সমাগম ঘটে। যাত্রা বিরতির এই অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের চিতই পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

উর্ধ্বশ্বাসের দুই ঘন্টা

বাহাদুরপুরের অনুষ্ঠান শেষে জোসনা ঝড়ানো পানিপথে আবার যাত্রা শুরু হয়। ঝলমলে আকাশে সাদা মেঘের ভেলার উড়ে যাওয়া ফিরে আসা। হঠাৎই কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে উঠলো পূব আকাশে। টিপ টিপ বৃষ্টি হয়ে জিরাচ্ছিল আকাশ। ভরা জোসনায় বিস্তীর্ন জলরাশির দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়ার সময় রাত ১১টার দিকে শুরু হয় দমকা বাতাস, সঙ্গে বৃষ্টি।

এ সময় হাওরে জোরেসোরে ঢেউ উঠে। দুলতে থাকে ট্রলার। বৃষ্টির ঝাপটা সামলে নিয়ে ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রাণে ভরা নিষ্প্রাণ নৌযানটি যেন গর্জে উঠে ছুটতে থাকে। বাতাস বাড়তে থাকলে এক সময় ট্রলার চালক লগি দিয়ে পানির গভীরতা পরিমাপ করে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় নোঙ্গর ফেলে। বাতাস থামলে আবার শুরু হয় যাত্রা। শেষ পর্যন্ত এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে রাত ১টার দিকে সাংবাদিকরা খালিয়াজুরি পৌঁছায়।


Mottaliবাউল শ্রেষ্ঠ সুনীল কর্মকার

খালিয়াজুরি উপজেলা চেয়ারম্যান সামছুজ্জামান তালুকদার সোয়েব সাংবাদিকদের স্বাগত জানান। রাত ২টায় স্থানীয় গালর্স স্কুল মাঠে বসে বাউল গানের আসর। হাওর জনপদের শতশত মানুষ ঘুম থেকে উঠে এসে গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান উপভোগ করে। এ অনুষ্ঠানে বর্তমান সময়ের বিখ্যাত বাউল ‘সুনীল কর্মকার’ কে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংবাদিক সমিতি-ঢাকা ‘বাউল শ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে সম্মাননা প্রদান করে।

বাউল শ্রেষ্ঠ সুনীল কর্মকার তার দরাজ গলায় ভাব সঙ্গীতে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। অনুষ্ঠানে সুনীল ভক্তরা তাকে সোনার চেইন ও অর্থ উপহার দেয়। একজন ভক্ত সুনীলকে খালিয়াজুরিতে বসবাসের আহবান জানিয়ে একটি বাড়ি দান করার কথাও ঘোষণা করেন।

অনুষ্ঠানে সুনীল কর্মকারের সঙ্গে তার সহশিল্পী জেসমিন সরকার এবং সাংবাদিক রফিক সাদি সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

রাত চারটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলার পর নৈশভোজ হয়। খালিয়াজুরির নৈশভোজেও ছিল মাছের ছড়াছড়ি। লাল মরিচে বাটা চেপা ভর্তা থেকে শুরু করে হরেক পদের মাছ ও মাংস দিয়ে তারা সাংবাদিকদের আপ্যায়ন করেন।

সচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটা

হাওরের খাল বিল নদী নালা ধানের ক্ষেতে বিস্তীর্ন জলরাশি। এখানে পানির স্তর এক সমান নয়। উপর থেকে দেখলে সবই সমান মনে হয়। কিন্তু লগি দিয়ে পরিমাপ করলে দেখা যাবে একেক জায়গায় পানির গভীরতা একেক রকমের। সাংবাদিকরা সকালে হাওরের নিরাপদ জায়গায় সচ্ছ পানিতে ইচ্ছেমত সাঁতার কাটেন।haor

বর্তমানে বাংলাদেশের কোন নদী-নালা ও খালে-বিলে দুষন মুক্ত পানি নেই। সবখানেই শিল্পবর্জ্যে দূষিত। এক্ষেত্রে একমাত্র হাওরই হচ্ছে বিকল্প। হাওরের পানি সচ্ছ। কারণ হাওরের জলধারার উৎসে এবং চারপাশে কোন শিল্প-কারখানা নেই। পানি দেখলেই যাদের ইচ্ছে করে একটু সাঁতার কাটতে কিংবা ছেলে-মেয়েদের যারা সাঁতার শিখাতে চান তারাও স্বপরিবারে হাওরে বেড়াতে যেতে পারেন। ট্রলার চালকদের বললেই তারা সাঁতার কাটার নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে।

মিঠামইনের রাত

খালিয়াজুরি থেকে বিদায় নিয়ে ইটনায় মধ্যাহ্নভোজ সেরে সাংবাদিকরা বিকেলে মিঠামইনে উপস্থিত হন। মিঠামইন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট এর জš§স্থান ও নির্বাচনী এলাকা। মিঠামইনে রাষ্ট্রপতির কনিষ্ঠ ভ্রাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিন্সিপাল আব্দুল হক (নুরু) সাংবাদিকদের অভ্যর্থনা জানান।

সন্ধ্যার পর বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় হয়। পরে বসে গানের আসর। মিঠামইনের স্থানীয় শিল্পীরা লোকসঙ্গীত ও পুঁথিপাঠে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন। মিঠামইনের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গীতানুরাগ ও রসবোধে ঢাকার সাংবাদিকরা বিস্মিত হন।

মিঠামইনের স্বভাবশিল্পীদের পরিবেশনা দেখে মনে পড়ে যায় ইংরেজরা কেন ময়মনসিংহকে ‘মাই ম্যান সিং’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। প্রিন্সিপাল আব্দুল হক নিজেও নিঃসংকোচে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ আয়োজনে যারা গেয়েছেন আর যারা শুনেছেন তাদের প্রত্যেকের অঙ্গভঙ্গিই বলে দেয় এরা যথার্থই সুরের সমঝদার। সুরের এই ভাব ও ভঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে সৃষ্টি করা যায় না। এটা মাটি ও প্রকৃতি থেকে জš§ নেয়। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বলেই ভাটি অঞ্চল এ দেশের সংস্কৃতির সুতিকাগার। এ কারণেই ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র সৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে।

হাওরে বেড়াতে গেলে সঙ্গে রাখবেন গানের আয়োজন। আর সে গান যদি হয় বাউল কিংবা মুর্শিদী-মারফতি, জারি-সারি, ভাটিয়ালী তাহলে হাওর জনপদে মানুষের ঢল নামবে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও দেখবেন কিভাবে গানের সুর আতœস্থ করে। ভাটি অঞ্চলে কেন সুরের জন্ম দেয়, আউল-বাউল, জারি-সারি, মুর্শিদী-মারফতি, ভাটিয়ালীসহ পালা গানের বিকাশ ও বিস্তৃতি কেন এই অঞ্চলে হয়েছে ভরা বর্ষায় উজান-ভাটির হাওর জনপদে ঘুরে বেড়ালে তা উপলব্ধি করা যাবে।

ফেরার পথে

মধ্যরাত পর্যন্ত সময় কাটে মিঠামইনের গানের আসরে। পরে মুষলধারে বৃষ্টির শব্দে ঘুমের ঘোরে রাত কাটে। সকালে রাষ্ট্রপতির বাড়িতে চা-নাশতার আয়োজন হয়। এখানে সবাই রাষ্ট্রপতির বাড়ি ঘুরে দেখেন। স্থানীয় লোকদের মুখে তার রাজনৈতিক জীবনের গল্প শুনেন। গল্পে গল্পে উঠে আসে একজন আব্দুল হামিদ কিভাবে অপরাজিত মান্য থেকে মহামান্য হয়েছেন।

মিঠামইন থেকে সাংবাদিকদের পরবর্তী যাত্রা শুরু হয়। এবার ফেরার পালা। সকাল ১০টার দিকে সাংবাদিক দলটি পৌঁছে যায় চামড়া বন্দরে। এখানে নেমেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাজা মাছ কেনায়। পছন্দমতো হরেক কিসিমের মাছ কিনেন সবাই। মাছ কেনা শেষ হলে আবার যাত্রা। শেষ বিকেলে সবাই পৌঁছে যান রাজধানী ঢাকায় যার যার ঠিকানায়।

ফেরার সময় মনে হল কি যেন ফেলে যাচ্ছি এই সরব ঢেউয়ের মাঝে। পাশাপাশি বিধ্বস্ত ও অবহেলিত হাওরবাসীর প্রফুল্ল চেহারাটাও ভেসে ওঠে হƒদয়ের মাঝে। এত সংগ্রাম ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিসের মায়ায় তারা এই হাওর অঞ্চলে পড়ে আছে। তাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখের সামনে।

shilpiলেখক: সাংবাদিক

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer