ঢাকা: শ্রেষ্ঠ কে? পেলে না ম্যারাডোনা— এ বিতর্ক দীর্ঘদিনের। রাত ফুরিয়ে যায়, তবু বিতর্ক শেষ হয় না। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলে সেরা খেলোয়াড় বিতর্কে নতুন নাম মেসি। আরেক জীবিত কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুয়েফ এরই মধ্যে বলে ফেলেছেন, সেরা হওয়ার জন্য বিশ্বকাপ জেতার প্রয়োজন নেই। ফুটবল ইতিহাসে মেসিই সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড়। আপনাকে যদি বলা হয়, নিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়ে এ তিনজনের মধ্যে একজনকে বেশি নম্বর দিতে। তাহলে নিশ্চয় বিপদে পড়ে যাবেন।
রেকর্ড বই সামনে নিয়ে বসলেও একসময় হয়তো রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হবেন এবং বলে বসবেন, এ বড় কঠিন কাজ এবং এটি আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আসলে ফুটবলের আকাশে এরা তিনজনই জ্বলজ্বলে তারকা। এটিই স্বাভাবিক, কেননা কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দুজনকে বাদ দিয়ে একজনকে বেছে নেয়া কার্যত অসম্ভব।
পেলে (জন্ম ২১ অক্টোবর, ১৯৪০) তার ক্যারিয়ারে ১ হাজার ১৬৩টি ম্যাচে গোল করেছেন মোট ১ হাজার ২৮১টি। এর মধ্যে আনঅফিশিয়াল প্রীতিম্যাচ ও ট্যুর গেমও রয়েছে।
ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি গোলদাতা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে তার নামটিই লিপিবদ্ধ রয়েছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। শুধু ভালো খেলোয়াড়ই ছিলেন না, তার সমাজ সচেতনতার কথা কমবেশি সবাই জানে। একসময় ব্রাজিলের দরিদ্র মানুষের সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। খেলোয়াড় হিসেবে কীর্তির কারণে ১৯৬১ সালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেনিও কাড্রস তাকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করেছিলেন। এ সম্মান ব্রাজিলের আর কোনো খেলোয়াড় পাননি।
সম্ভবত পেলেই একমাত্র ফুটবলার, যিনি যুদ্ধ থামিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। বায়াফ্রা যুদ্ধ চলাকালীন ব্রাজিলীয় দল স্যান্তোসের হয়ে নাইজেরিয়া পৌঁছার পর দুদিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। যাতে জনগণ ‘দ্য কিং অফ দ্য বিউটিফুল গেম’-এর উপস্থিতি উপভোগ করতে পারে। তার সেই ম্যাচ দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল লোকজন।
পেলের ফুটবল স্টাইল সম্পর্কে উরুগুয়ের স্ট্রাইকার এডুয়ার্ডো গালিয়ানোর চেয়ে ভালো বর্ণনা কেউই দিতে পারেননি। ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জোরে দৌড়াতে গিয়ে তিনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের এমনভাবে পেছনে ফেলতেন যেন মাখনের ওপর চালানো হয়েছে গরম ছুরি। যখন তিনি থামতেন তখন তাদের পা জড়িয়ে আসত। যখন তিনি শূন্যে লাফিয়ে উঠতেন তখন তাকে মনে হতো ফড়িং। তার খেলার অসাধারণ সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে, নইলে বিশ্বাসই করতাম না যে, অমরত্ব বলে কিছু আছে।’
পেলে যেখানে আপাদমস্তক ভদ্রলোক, সে জায়গায় ম্যারাডোনা (জন্ম ৩০ অক্টোবর, ১৯৬০) এখনো অনেক সময় পথশিশুর মতো আচরণ করেন। বিতর্কিত বলে অনেকে তাকে পেলের কাতারেই আনতে চান না। আসলে তর্কের খাতিরে তর্ক অনেক চালানো যায়। কিন্তু তিনি যে বিশাল খেলোয়াড় ছিলেন, এটি যারা না মানেন, তাদের এক প্রকার বোকাই বলা যায়। আর এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ফিফা)। পেলে ও ম্যারাডোনাকে যুগ্মভাবে বিংশ শতাব্দীর সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করেছিল ফিফা।
ইতালিয়ান ক্লাব ন্যাপোলিতে থাকা অবস্থায় পেশাদার ক্যারিয়ারের চূড়ায় পৌঁছেছিলেন ম্যারাডোনা। অখ্যাত ক্লাবটিকে বিখ্যাত বানিয়ে দেয়ার নায়ক যে তিনিই। তার হাত ধরে ন্যাপোলি প্রবেশ করেছিল ইতিহাসের সবচেয়ে সফল যুগে। ন্যাপোলি তার হাত ধরে সেরি এ ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল দুবার (১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৯-৯০)। উয়েফা (ইউনিয়ন অফ ইউরোপিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) কাপ দখল করেছিল ১৯৮৯ সালে আর ইতালিয়ান সুপারকাপ ১৯৯০তে। তার কীর্তির কারণে ন্যাপোলি শহরে আজও তাকে ভক্তি করা হয় ধর্মীয় নেতার মতো। শহরের কেন্দ্রস্থলে বেশ কয়েকটি রাস্তায় তার স্মৃতিচিহ্ন কিংবা মুরাল রয়েছে।
১৯৮৬-এর বিশ্বকাপ মানেই যেন ম্যারাডোনা। ওই বিশ্বকাপে তার অসাধারণ নৈপুণ্যের কারণেই মূলত আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। যে সুবাদে বিশ্বকাপ এলেই ঘুরে ফিরে উচ্চারিত হয় তার নামটি। গ্রেট ব্রিটেনের বিপক্ষে করা ম্যারাডোনার দ্বিতীয় গোলটি ফিফার ভোটে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা গোল নির্বাচিত হয়। মাঝমাঠে বলটি পেয়ে ১১টি টাচের পর গোল আদায় করে নিয়েছিলেন। তার ড্রিবলের কাছে পাঁচ পাঁচজন আউটফিল্ড প্লেয়ারের (পিটার বার্ডসলে, স্টিভ হজ, পিটার রিড, টেরি বুচার ও টেরি ফেনউইক) বোকা বনে যাওয়া দেখে বিস্মিত হয়েছিল ফুটবলবিশ্ব।
গোলটি করতে গিয়ে গোলরক্ষক টিচার শিলটনকেও কাটিয়েছিলেন তিনি। এর ৪ মিনিট আগে হয়েছিল সেই কুখ্যাত ‘ঈশ্বরের গোল’। পরে তিনি স্বীকার করে নেন যে, হেড করতে লাফিয়ে উঠলেও গোলটি করেছিলেন হাত দিয়ে, যা রেফারি ধরতে পারেননি। অবশ্য স্বীকার না করলেও ছবি ও ভিডিও রেকর্ডের মাধ্যমে সত্য বেরিয়ে আসত। গোলটি নিয়ে আজো বিতর্ক চলে এবং বিশ্বকাপ থেকে গ্রেট ব্রিটেনের বিদায় হওয়ার জন্য দোষ দেয়া হয় ম্যারাডোনাকে।
’৮৬-এর বিশ্বকাপ চলাকালে ব্রায়ন বাটলার বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘ম্যারাডোনা ছোট বাইম মাছের মতো শরীর বাঁকাতে পারেন। জটলার মাঝ থেকে ঠিকই বেরিয়ে যেতে পারেন বল নিয়ে এবং কাকে কখন বল দিতে হবে এ বিষয়ে তার চেয়ে দক্ষতা আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেননি। একটি দলকে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলতে তিনি একাই যথেষ্ট।’ এসব কারণেই মিশেল প্লাতিনি ম্যারাডোনাকে মনে করেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার। তার একটি মন্তব্য ছিল, ‘জিনেদিন জিদান (বিশ্বকাপের আরেক নায়ক) যা বল দিয়ে করতে পারেন, তা ম্যারাডোনা পারবেন একটি কমলা দিয়ে।’
লিওনেল মেসি ম্যারাডোনার মতো নয়। তিনি শান্ত, লাজুক এবং কথা বলতে খুব একটা পছন্দ করেন না। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা এ ফুটবলারের জন্ম আর্জেন্টিনার সান্তা ফে প্রদেশের রোজারিওতে ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন। গত পাঁচ বছরের মধ্যে চারবারই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। চারটি ফিফা ব্যালন ডি’অরের পাশাপাশি তিনটি ইউরোপিয়ান গোল্ডেন সু অ্যাওয়ার্ডস জেতা একমাত্র ফুটবলার তিনি। ছোটখাটো শারীরিক গড়নকে কাজে লাগিয়ে বিপক্ষের জালে বল পাঠাতে তিনি সিদ্ধহস্ত। জাল তাকে চুম্বকের মতো টানে। চোখ থাকে ওদিকেই। মূল উদ্দেশ্য থেকে তাকে বিচ্যুত করা কঠিন কাজ।
বার্সেলোনায় বসবাসরত আর্জেন্টাইন লেখক ও মেসির সেরা ভক্ত হার্নান কাসিয়ারির মূল্যায়ন হচ্ছে, সম্মোহন শক্তি রয়েছে মেসির। প্রতিপক্ষের জালে কেবলই বল পাঠাতে চান তিনি। খেলা, খেলার চূড়ান্ত ফলাফল ও খেলার নিয়ন্ত্রণ— এ বিষয়গুলো যেন ভুলে যান তিনি। আড়চোখে তাকান, যাতে বিপক্ষের খেলোয়াড়রা আন্দাজ করতে না পারেন, তিনি কী করতে চাইছেন। এটাই মেসির বিশেষ কৌশল। খেলা চলাকালে তাকে ছুরি মারলেও দৃষ্টি মনে হয় বলের ওপরই থাকবে। এক্ষেত্রে চিলের সঙ্গে তার তুলনা চলে।’
পেলে, ম্যারাডোনা ও মেসির মধ্যে একজনকে সেরা হিসেবে বেছে নেয়া কঠিন কাজ। তিনজনেরই বৈশিষ্ট্য আলাদা, তবে মানের প্রশ্নে তারা একই শ্রেণীভুক্ত। কয়েক শতাব্দী পরেও সম্ভবত উচ্চারিত হবে তাদের নাম। এটুকু অন্তত সাহস করে বলা যায়— এ তিনজনই ফুটবল ইতিহাসের সেরাদের সেরা।
লেখক: শিক্ষক ও অনুবাদক
বণিক বার্তা-য় প্রকাশিত
বহুমাত্রিক.কম